সচেতন নাগরিকেরা অনেকেই দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে একটা প্রলম্বিত লড়াইকে কল্পনায় দেখছেন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তিনি কোনও অগ্নিস্রাবী বক্তা নন। তাঁর চেহারায় গ্ল্যামারের চিহ্নমাত্রও নেই। এবং সেই সঙ্গে প্রায় সকলেই জানেন, নির্বাচনে তাঁর জেতার আশাও প্রায় নেই বললেই চলে। তবু সিপিএমের তরুণ নেত্রী ৩৩ বছর বয়সি মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের নতুন তারকা হিসেবে অভাবনীয় ভাবেই উঠে এসেছেন। নন্দীগ্রামে তাঁর শান্ত অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রচারের ভিডিয়ো ইতিমধ্যেই নেটমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি যাঁরা সে অর্থে বাম সমর্থক নন, তাঁরাও মিনাক্ষীর প্রতি একটা সমীহ দেখাচ্ছেন। নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম তাঁর একদা পৃষ্ঠপোষিত এবং বর্তমানে প্রতিদ্বন্দ্বী শুভেন্দু অধিকারীর লড়াইয়ের চড়া সুরে বাঁধা কোলাহলের মধ্যেও যে ভাবে মিনাক্ষী নিজের উপস্থিতিকে স্পষ্ট করে তুললেন, তা এই সমীহের পিছনে সব থেকে বেশি পরিমাণে কাজ করেছে সন্দেহ নেই।
কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই হঠাৎ মাথাচাড়া দেওয়া জনপ্রিয়তার পিছনে মিনাক্ষীর ব্যক্তিত্ব যতটা না কাজ করেছে, তার থেকেও বেশি মাত্রায় কাজ করেছে ‘বিষয়’ হিসেবে তাঁর অস্তিত্ব। সে ভাবে দেখলে এই ‘বিষয়’টি হল ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে এ রাজ্যে বামশক্তির পুনরুত্থান-প্রচেষ্টার অঙ্গ হিসেবে উঠে আসা বেশ কিছু তরুণ মুখচ্ছবি। এবং মিনাক্ষী যে সংবেদ আদায় করতে সমর্থ হয়েছেন, তা এই নির্বাচনী পরিমণ্ডলে তৃণমূল ও বিজেপি-র দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝলকানির চাপে প্রায় নীরবতায় পর্যবসিত এক বৃহত্তর প্রবণতাকে স্পষ্ট করে তুলতে সমর্থ হয়েছে। সিপিএমের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত মোর্চার অস্তিত্ব এর ফলে আর উপেক্ষাযোগ্য হয়ে থাকেনি। বঙ্গ-রাজনীতিতে এই মোর্চার গুরুত্ব ভাল ভাবেই অনুভূত হচ্ছে।
সিপিএম এ বার শুধুমাত্র তরুণদের প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করায়নি, প্রচার ও অন্যান্য পরিকল্পনার দায়িত্বও তরুণদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। ছবি - পিটিআই।
বর্তমান শাসকদলের বিরোধিতার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের যে প্রচার বিজেপি চালাচ্ছে, এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রচণ্ড ভাবে, বিশেষ করে শীতলখুচি-কাণ্ডের পরে, যে লড়াই চালাচ্ছেন সেই আবহাওয়ায় কোনও ‘তৃতীয় শক্তি’-র অস্তিত্ব জানান দেওয়ার পরিসর সীমিত। তার উপর আবার নির্বাচনী হাওয়া ভোটদাতাদের ‘বিজয়ী পক্ষ’-এর দিকে অধিক মাত্রায় ঝোঁকার প্রবণতা তৈরি করে রেখেছে। এমতাবস্থায় সংযুক্ত মোর্চা (চলতি বাংলায় যাকে ‘জোট’ বলা হচ্ছে) বেশ পিছিয়েই রয়েছে বলা যায়। অন্ততপক্ষে তার কোথাও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জিতে আসার আশা কেউই করছেন না বলা যায়।
এই সব কারণ ছাড়াও, অথবা বলা যায় এই সব কারণের জন্যই এই নির্বাচনের বিস্ময়কর দিকটা হল এই যে, কিছু সংখ্যক মানুষ যে দৃষ্টিতে বামেদের দিকে যে দৃষ্টিতে দেখছেন, তাতে হতাশার চাইতে আশাই বেশি। অথচ বিস্ময়কর বিষয় এই যে, মানুষের ধারণা এবং বাস্তব উভয় ক্ষেত্রেই একদা মহাপরাক্রমশালী বামশক্তি তার অন্তিম যাত্রায়। ২০১১ সাল থেকে তৃণমূলের উত্থানে তার সাংগঠনিক পতনের সূত্রপাত হয় এবং ২০১৪-য় যখন কেন্দ্রে দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদ ক্ষমতা দখল করে ও ২০১৬-এর পর থেকে বাংলার দিকে তার বিস্তার শুরু হয়, তখন বোঝা যেতে থাকে যে, এই উভয় সঙ্কটের মোকাবিলা করতে বামশক্তি অক্ষম। এই অক্ষমতার ছাপ দৃশ্যমান হয় গত ১০ বছরের ভোটব্যাঙ্কেও।
২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে যখন বামেরা ক্ষমতা হারায় এবং মাত্র ৪০টি আসনে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখে, তখনও কিন্তু ৩০ শতাংশের বেশি ভোট সিপিএমের দিকেই ছিল। ২০১৬-য় তা কমে দাঁড়ায় ২০ শতাংশে। ২ বছর আগে লোকসভা নির্বাচনে তা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে এবং সিপিএম একটিও আসন লাভে অসমর্থ হয় এবং মাত্র ৬.৩৪ শতাংশ ভোট পায়।
সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনের পরিস্থিতিতে বঙ্গীয় বামশক্তির ভাটির টান অদৃষ্টপূর্ব। তৃণমূল আর বিজেপি-র মতো দুই সবল প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করার পাশাপাশি রাজ্যের বাইরে থেকেও ধর্মনিরপেক্ষ ও অন্যান্য বামশক্তির সমালোচনার সামনে বঙ্গীয় বামকুল।
রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টিতে জয়লাভ করে, মোট ভোটের ৪০ শতাংশ দখল করে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-র অভাবনীয় সাফল্যের পরে ধর্মনিরপেক্ষ ও অন্যান্য বামশক্তির সমর্থকরা বুঝতে পারেন যে, বাংলায় বিজেপি-র উত্থান রুখতে বঙ্গীয় বামেরা আদৌ সমর্থ নন। বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত শক্ত করাই শ্রেয়। বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং সমাজকর্মীদের মধ্যে এই নিয়ে তরজা নেটমাধ্যমের ভার্চুয়াল জগতে রীতিমত নজর কাড়তে শুরু করে। অনেকেই সিপিএমের নির্বাচনী কৌশল এবং সংযুক্ত মোর্চা গঠনেরও তীব্র সমালোচনা করতে থাকেন।
সব নির্বাচন জেতার জন্য নয়। জনসংযোগ নির্মাণ, বহুশ্রুত হওয়া, নতুন অংশকে আকৃষ্ট করা, এমনকি দুর্নাম দূর করে সুনাম অর্জনের পথও বটে। ছবি - পিটিআই।
বাস্তবে কিন্তু গল্পটা অন্য রকম দাঁড়ায়। বছরের পর বছর তৃণমূল সন্ত্রাসের সমালোচনা করে নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করাটা যুক্তিযুক্ত ছিল না। বাম নেতৃত্ব বোঝাতে থেকেন যে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের সময়ে ‘আগে রাম, পরে বাম’-এর ফিসফিস স্লোগান আসলে আরএসএস-এর প্রচার, এর উদ্দেশ্য বাম ভোটারদের বিভ্রান্ত করে দেওয়া। সেই সঙ্গে গণমাধ্যম এবং তৃণমূলও এই বিষয়টাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সামনে নিয়ে আসে এবং দাবি করতে থাকে যে, এটা বামেদের মস্তিষ্কপ্রসূত একটা কৌশল। এই ‘আগে রাম, পরে বাম’ জিগিরের উৎস যেখান থেকেই হোক না কেন, এর ফল এমন দাঁড়ায় যে, ২০১৯-এ বাম সমর্থকদের একটা বড় অংশ বিজেপি-র দিকে ঢলে পড়েন। তাঁদের মধ্যে অনেকে, বিশেষ করে তলার দিকের বাম সমর্থকরা এমনও মনে করে থাকেন যে ‘তৃণমূল সন্ত্রাস’ থেকে বামশক্তি তাদের রক্ষা করতে অপারগ।
এমতাবস্থায় বামকর্মীরা দেখান যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষ সংহতি’ গঠনে তৃণমূলের পাশে দাঁড়ালে তা প্রকারান্তরে বিজেপি-কে সাহায্য করাই দাঁড়াবে। তৃণমূলের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাম-সহানুভূতির ধারক ও বাহকদের মনোবৃত্তি এমনটাই দাঁড়ায় যে, এর ফলে বাম ভোটারদের আর একটা বড় অংশ বিজেপি-র দিকে ঢলে পড়বে।
আদর্শগত ভাবেও বাংলার ভিতরে ও বাইরে মমতার ভাবমূর্তির মধ্যে একটা বিশাল ফারাক রয়েছে। দেশের অন্যত্র বিজেপি-সমালোচকদের চোখে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার মূর্ত প্রতিরূপ, একা হাতে বিজেপি-র বিক্রমকে সামলে দিতে পারেন। কিন্তু বাংলায় সব রকমের বামপন্থীদের মত এর বিপরীত। তাঁদের ধারণায়, বাংলায় বিজেপি-র উত্থানে মমতার অবদান বিভিন্ন ভাবে কাজ করেছে। ‘বিরোধী মুক্ত’ বাংলা গড়তে (গ্রামবাংলায় বামেদের সংগঠনকে ধ্বংস করার পাশাপাশি বিপুল হারে কংগ্রেস বিধায়কদের তৃণমূলে নিয়ে আসার বিষয়টিকে মাথায় রেখে) জাত-পাত ও ধর্ম-ভিত্তিক রাজনৈতিক প্রবণতা প্রথমে আরএসএস ও পরে বিজেপি-কে বাম-উত্তর জমানায় বাংলার রাজনীতিতে নতুন ফাটল খুঁজে বার করতে সাহায্য করে।
কিন্তু যখন তাত্ত্বিক বা ভাবগত বিন্দু থেকে তৃণমূল-বিরোধিতা বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটা প্রয়োজনীয় আয়ুধ হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে, তখন তার সার্থক ও বাস্তব প্রয়োগের বেলায় ঘটে যাচ্ছে অন্য কিছু।
এই কাজটা করতে গিয়ে বামেরা এই নির্বাচনে এক নতুন কৌশল অবলম্বন করেন, যা অনেকের মতে এই ‘ইয়ুথ ফ্যাক্টর’। জানুয়ারি মাসে সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠকে স্থির হয়, তাদের প্রার্থীদের ৬০ শতাংশ হবেন ৪০ বছরের কম বয়সি এবং কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া কোথাওই যেন প্রার্থীর বয়স ষাটোর্ধ্ব না হয়।
মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় ছাড়াও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেত্রী দীপ্সিতা ধরকে বালিতে, জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ঐশী ঘোষকে জামুরিয়ায়, এসএফআই-এর রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্যকে সিঙ্গুরে, এসএফআই সভাপতি প্রতিকুর রহমানকে ডায়মন্ড হারবারে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানোয় তা গণমাধ্যমের নজর কেড়েছে। শুধু মাত্র তারুণ্যের কারণে এঁদের সঙ্গে পূর্বসূরীদের পার্থক্য, তা কিন্তু নয়। এঁদের অনেকেই এসেছেন খুব সাধারণ পরিবার থেকে। যেমন, নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের প্রার্থী ঝুনু বৈদ্য এক ভাগচাষি ঘরের সন্তান অথবা বর্ধমানের চণ্ডীচরণ লেটের বাবার একটা সাইকেল সারাইয়ের দোকান রয়েছে। এক বৃদ্ধ বামপন্থীর উক্তি, “দীর্ঘ দিন পরে কমিউনিস্ট পার্টি কমিউনিস্ট প্রার্থীদের মনোনয়ন দিল।”
এখন যে সব তরুণ-তরুণীরা দলে যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের সামনে সুবিধাবাদ আর আখের গোছানোর রাস্তা আর খোলা নেই। ছবি - পিটিআই।
সিপিএম এ বার শুধুমাত্র তরুণদের প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করায়নি, তারা নির্বাচনী প্রচার ও অন্যান্য পরিকল্পনার দায়িত্বও তরুণদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে। বামেদের এ যাবৎ ক্রিয়াকাণ্ডে এমনটা দেখা যায়নি। বলা যেতে পারে, এর ফলে একটা খোলা হাওয়া দেখা দিয়েছে বাম-বাতাবরণে। সমাজমাধ্যমে বুদ্ধিদীপ্ত অথচ মজাদার মিম, নজরটানা ভিডিয়োর ক্রমাগত উপস্থাপন রাজ্যের নব্য প্রজন্মের একাংশকে নিঃসন্দেহে এ দিকে নজর দিতে বাধ্য করে। ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিগ্রেডের আগে চলতি হিট ‘টুম্পা সোনা’-র প্যারোডি পার্টির বয়স্ক কমরেডদের গণনাট্য-গণসঙ্গীতে অভ্যস্ত কানে কিছুটা ‘শক’ হিসেবে প্রতিভাত হয়। কিন্তু এটা অস্বীকার করা যাবে না যে ‘টুম্পা’-র এই প্যারোডি বিপুল জনগ্রাহ্যতা পায় এবং বামেদের তরফে প্রার্থীতালিকা ঘোষণার আগেই এক ‘বদল’ যে আসছে, তা বোঝাতে সমর্থ হয়।
বামেদের এই তরুণ বয়স্কদের প্রার্থী করার বিষয়টাকে বিজেপি এবং তৃণমূল উভয়েই নির্বাচনী কৌশল হিসেবে না দেখে ‘সস্তা চমক’ হিসেবে উড়িয়ে দিতে চায়। দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার ফলে সিপিএম-কে এক স্থিতাবস্থায় বিশ্বাসী বলেই দেখা হয়, যেখানে দলের নীচের দিকে শ্রমিক-কৃষক থাকলেও নেতৃত্বে থাকেন সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি শোভিত মধ্যবিত্ত ‘ভদ্রলোকে’রা। ১৯৬০-এর দশকে এবং ১৯৭০-এর দশকের গোড়ায় যাঁরা গণ আন্দোলনের মধ্যে থেকে উঠে এসেছিলেন, তাঁরা আজ বৃদ্ধ। পরে যখন দল ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে, ‘সংগ্রাম’, ‘স্বার্থত্যাগ’ ইত্যাদি শব্দ যখন অন্তঃসারশূন্যতায় পর্যবসিত, সেই সময়ে যাঁরা দলে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের কাহিনি আলাদা। আবার আজকের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। বামশক্তি আজ দুর্বলতম এবং রাতারাতি এর পুনরুজ্জীবনের কোনও সম্ভাবনা নেই। এখন যে সব তরুণ-তরুণীরা দলে যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের সামনে সুবিধাবাদ আর আখের গোছানোর রাস্তা আর খোলা নেই। বরং এক ধরনের আদর্শ আর প্রত্যয়তাড়িত হয়েই তাঁরা দলে আসছেন। তাঁরা জানেন, নির্বাচনের এই লড়াই তাঁদের প্রথম পদক্ষেপ মাত্র, এর পরে সামনে পড়ে রয়েছে দীর্ঘ যাত্রাপথ।
নতুন নির্বাচনী কৌশলের আর একটা হল ‘জীবন-জীবিকা’-র বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসা। বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, ক্ষুধা— ইত্যাদি বিষয়ে সরব হওয়া। যেখানে তৃণমূল আর বিজেপি, উভয়ের প্রচারেই গুরুত্ব পাচ্ছে ধর্ম আর এথনিক বিষয়সমূহ।
তৃতীয় এবং সব থেকে বিতর্কিত বিষয়টি হল সংযুক্ত মোর্চা গঠন। শুধুমাত্র কংগ্রেস নয়, এই জোটে হুগলির ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)-ও শামিল। সিপিএম সমর্থকরা তাঁদের দীর্ঘকালীন কংগ্রেস বিরোধিতাকে অতিক্রম করতে পারেন, কিন্তু ‘ধর্মীয় উলেমা’ সম্প্রদায়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার ব্যাপারটা বামেদের অনেকেই ভাল ভাবে নেননি। যদিও আইএসএফ দলিত ও আদিবাসীদের সঙ্গে নিয়ে একটা বহুধর্মীয় চরিত্র অর্জনে সচেষ্ট বলে দাবি করে এবং সিদ্দিকির বক্তৃতা ধর্মীয় বিষয়ের চাইতে ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়কে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে, তবু বহু বাম সমর্থক এই সিদ্ধান্তকে সহজ ভাবে নিতে পারেননি। জনৈক সিপিএম নেতা জানিয়েছেন ‘জোট’ গঠনের এই সিদ্ধান্ত আসলে তৃতীয় শক্তিকে আরও ‘দৃশ্যমান, বিশ্বাসযোগ্য ও জয়ের যোগ্য’ করার জন্যই গৃহীত। এখনও পর্যন্ত এই ‘দৃশ্যমানতা’র ব্যাপারটা বেশ সত্য, কারণ সিদ্দিকি (জনতার কাছে ‘ভাইজান’) তাঁর বক্তৃতা বা মিছিলে বিপুল জনতাকে একত্র করতে সমর্থ হয়েছেন। এখন এই জোট জয়ের উপযুক্ত কিনা তার প্রমাণ পেতে সপ্তাহ কয়েক অপেক্ষা করতে হবে। আর বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে আরও খানিকটা বেশি সময় লাগবে।
অনেকেরই মত— বামেদের ভবিষ্যৎ রয়েছে, যদিও বর্তমানটা বেশ খারাপ। ছবি - পিটিআই।
এখন প্রশ্ন হল, বামেদের এই নতুন নিরীক্ষা কি আদৌ কাজ করছে? উত্তর একই সঙ্গে নেতিবাচক ও ইতিবাচক। মফস্সল, গ্রাম এবং মহানগরের বিস্তর চৌমাথার মিটিং আর চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, এই নির্বাচনের কেন্দ্রে রয়েছে তৃণমূল আর বিজেপি-র মেরুবিভাজনের তরজা। বিধানসভার এক তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে ‘জোট’ ভাবতে পারে। ভাবা মানেই কিন্তু জেতা নয়, এটা মনে রাখতে হবে। এবং ‘পরিবর্তন’-এর হাওয়া যদি মূল চরিত্র অর্জন করে, তা হলে এই ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে হাতে গোনা কয়েকটি আসনের অতিরিক্ত কিছু লাভ হবে বলে মনে হয় না।
কিন্তু সব নির্বাচন জেতার জন্য নয়। জনসংযোগ নির্মাণের, বহুশ্রুত হওয়ার, সমাজের নতুন অংশকে আকৃষ্ট করার এবং এমনকি দুর্নামকে দূর করে সুনাম অর্জনের পথও বটে। সে দিক থেকে দেখলে, এই নির্বাচন বামেদের কাছে ইতিবাচক। তাদের নির্বাচনী প্রচার ইতিমধ্যেই কাজ করতে শুরু করেছে বলে মনে হয়।
এমনকি যে সব আসনে বামেদের জেতার কোনও সম্ভাবনাই নেই, সেই সব জায়গাতেও বাম প্রার্থীদের নাম বিভিন্ন সূত্রে উঠে আসছে কথোপকথনে। উদাহরণস্বরূপ ডোমজুরের কথাই ধরা যাক। সেখানে একদা তৃণমূল মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপি-র টিকিটে লড়ছেন তৃণমূলের কল্যাণ ঘোষের বিরুদ্ধে। দু’জনেই ওজনদার প্রার্থী। সেখানে মিঠুন চক্রবর্তীর রোড শো দেখছিলেন দুই তরুণ— সায়ন নস্কর ও বিশ্বজিৎ বাগ। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, তাঁরা সম্ভবত ‘পরিবর্তন’-এর পক্ষেই ভোট দেবেন। কিন্তু নিজে থেকেই তাঁরা সেই আসনে সিপিএম তথা জোট প্রার্থী উত্তম বেরার প্রসঙ্গ তুললেন। সায়ন বললেন, “উত্তম বেরা ভাল লোক। মানুষকে সাহায্য করতে যে কোনও সময়ে প্রস্তুত।” তাঁর সঙ্গী বিশ্বজিৎ যোগ করলেন, “সিপিএমের প্রার্থীরা এ বার খুবই ভাল: এঁরা শিক্ষিত, নিয়মানুগ এবং ভদ্রও বটে।”
এই আবেগ বা অনুভবকে অন্য জায়গাতেও দেখা গেল। ‘শিক্ষিত’ আর ‘ভদ্র’— এই দুই বিশেষণ প্রায়শই উঠে এসেছে বাম বা জোট প্রার্থীদের প্রসঙ্গে। ১০ বছর হল বামেরা মসনদচ্যুত। ২০১১-র নির্বাচনে ‘পার্টি’-র বিরুদ্ধে উঠে আসা বিষোদ্গার আজ আর নেই। মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় আর সৃজন ভট্টাচার্য সপ্তাহের পর সপ্তাহ দোরে দোরে ঘুরে যথাক্রমে নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুরে প্রচার সেরেছেন। মনে রাখতে হবে, এই দুই স্থান থেকেই সিপিএমের পতনযাত্রার সূত্রপাত ঘটেছিল। আজ যে সেই বৈরিতা সেখানকার মানুষ আর পোষণ কছেন না, এঁদের অবাধ প্রচারেই তা স্পষ্ট প্রমাণিত।
আরও লক্ষণীয় হল এই যে, অনেকেরই মত— বামেদের ভবিষ্যৎ রয়েছে, যদিও বর্তমানটা বেশ খারাপ। যাদবপুরের এক ওষুধের দোকানের মালিক বিশ্বজিৎ দত্ত বললেন, ‘পরিবর্তন ঝড়’-এ সুজন চক্রবর্তীর মতো শক্তিশালী প্রার্থীও হেরে যেতে পারেন। কিন্তু সেই সঙ্গে এ-ও বললেন, “বামেরা ফিরবে, তাদের ফিরতেই হবে, ফেরা উচিত।”
আর একটু দূরে সোনারপুরে প্রণব ঘোষ বললেন, “বাম আসবে, আরও উন্নত বাম আসবে।” হুগলি জেলার চাঁপদানির এক অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক স্বীকারোক্তির সুরে বললেন, “বাম প্রচুর ভুল করেছে, কিন্তু শাস্তিও পেয়েছে। আবার নতুন হয়ে জেগে উঠবে।”
বামেদের কাছে এই নির্বাচন আসলে বৃহত্তর এক সংগ্রামের সুচনাবিন্দু মাত্র। পথ চলা এখনও বাকি। ছবি - পিটিআই।
নির্বাচন প্রকৌশলীরা বিশ্বাস করেন ভোটদাতাদের একটা বড় অংশ তেমন দল বা জোটকে ভোট দিয়ে তাঁদের ভোট ‘নষ্ট’ করতে চান না, যাদের ক্ষমতায় আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। এ ভাবেই তাঁরা ‘ভোট তরঙ্গ’-কে ব্যাখ্যা করেন, যা ভারতের অন্যত্র খুব সাধারণ এবং স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। পশ্চিমবঙ্গে এই ‘তরঙ্গ’ সম্প্রতি দেখা দিয়েছে।
কিন্তু বঙ্গ রাজনীতিতে দলীয় সমর্থনের ক্ষেত্রে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিশ্বস্ততার (কংগ্রেস এবং বাম উভয়েরই) একটা পরম্পরা রয়েছে। আজও বহু মানুষ (অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় লক্ষণীয় ভাবে বেশি) ‘জিততে চলেছে’ এমন দলের প্রতি ঢলে পড়েন না, মতাদর্শগত অবস্থানকে গুরুত্ব দেন।
রাজ্যে বিজেপি-র উত্থান এবং ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা ‘জোট’-এর পক্ষে এমন কিছু জায়গা থেকে সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হয়েছে, যা কার্যত অভাবনীয় ছিল। উবের ট্যাক্সিচালক এক বয়স্ক শিখ দমদমের নিকটবর্তী কোনও এলাকার বাসিন্দা। তাঁর কেন্দ্রের প্রার্থীদের নামও তিনি জানেন না। তাঁর উক্তি, “যো ভি জিতকে আয়ে, বঙ্গাল মেঁ বহোত ঝগড়া ফাসাদ হোনেওয়ালা হ্যায়।” সেই কারণেই তিনি এমন দলকে ভোট দিতে চান, যার মধ্যে আজও ‘নিয়মানুবর্তিতা’ রয়েছে।
রাজনৈতিক ভাবে সচেতন নাগরিকের ভাবনা আবার নির্বাচন-পরবর্তী ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটকে পেরিয়ে দেখতে চায়। তাঁরা দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে একটা প্রলম্বিত লড়াইকে কল্পনায় দেখছেন। বালিগঞ্জের বহুতল নিবাসী এক মধ্যবয়সি দম্পতি নির্বাচন শুরুর সময়ে নিশ্চিত ছিলেন না, কাকে ভোট দেবেন। কিন্তু পরে তাঁরা ‘জোট’-কেই ভোট দিতে চাইছেন। কারণ তাঁদের মতে, তৃণমূল এখন ও পরবর্তীতে এই আদর্শগত লড়াইয়ে সমর্থ নয়।
চলচ্চিত্র পরিচালক ও সমাজকর্মী সুমিত চৌধুরী বামফ্রন্টের শেষ পর্বে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম ও লালগড়ের আন্দোলনে গভীর ভাবে শামিল ছিলেন। তিনি জানালেন, ‘বাম, ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল’ ছাতার নীচে সমবেতদের মধ্যে বহু রকমের আদর্শগত বৈপরিত্য রয়েছে। এই সব বৈপরিত্য এবং বিতর্কই বামশক্তিকে প্রাণবন্ত রাখবে একতরফা হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। বাংলায় মাথা চাড়া দেওয়া নতুন শক্তির বিরুদ্ধে সম্মিলিত ভাবে লড়াইয়ের দিন এসে গিয়েছে। সুমিত বললেন, “আসল লড়াই শুরু হবে ২ মে-র পর থেকে।” এই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি কিন্তু শোনা গিয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে।
সিপিএমের নতুন তরতাজা মুখগুলিকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করার সিদ্ধান্ত তাদের ক্ষমতাসীন অবস্থায় অদৃষ্ট ছিল এবং নতুন সমঝোতা তৈরি করে বাংলায় বিরাজমান সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে রোখার চেষ্টাও ইতিপূর্বে অভাবিত। এ থেকে হয়তো নির্বাচনে আপাতত সীমিত কিছু লাভ হতে পারে। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, আসল পরীক্ষা এখনও বাকি থেকে গিয়েছে: পদ্ম-ঝড়ে প্লাবিত বাংলায় কি প্রাচীন বামবৃক্ষ থেকে উদ্গত নতুন বীজগুলি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে? নাকি তাদের মধ্যে সেই সহ্যশক্তি, সেই উদ্যম সুপ্ত রয়েছে, যা থেকে এক ক্রমজায়মান বৈরী পরিবেশেও শতফুল বিকশিত হবে? এই নির্বাচন আসলে বৃহত্তর এক সংগ্রামের সুচনাবিন্দু মাত্র। পথ চলা এখনও বাকি।