অদিতি মুন্সির কীর্তনের সুরে তাল দিলেন মমতাও —নিজস্ব চিত্র।
দোলের বিকেলে রেয়াপাড়ার আকাশে সাদা রঙের কপ্টারটা উঁকি দেওয়া মাত্রই মাঠে একটা শোরগোল পড়ে গেল। মোবাইলের ক্যামেরাগুলো তাক করা আকাশের দিকে। সঙ্গে ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাগতম’ ধ্বনি। রবিবার বিকেল তখন ৪টে ৫। মিনিট সাতেকের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর কপ্টার প্রচুর ধুলো উড়িয়ে নেমে পড়ল রেয়াপাড়ার মাঠে। তার পর হুইল চেয়ারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। অস্থায়ী হেলিপ্যাড থেকে কয়েক’শো মিটারের মধ্যেই তাঁর অস্থায়ী আস্তানা। পায়ে চোট। তাই রেয়াপাড়ার যে বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন তিনি, সেটার দোতলায় ঘর বলে আপাতত স্থানীয় এক দিদিমণির বাড়ির একতলায় থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী। ঢালাই রাস্তা বেয়ে সেখানেই প্রথমে গেলেন তিনি।
ঠিক ১৮ দিন পর দোলের দিন নন্দীগ্রামে ফিরলেন নন্দীগ্রামের তৃণমূল প্রার্থী মমতা। আর ফিরেই যোগ দিলেন বসন্ত উৎসবে। নন্দীগ্রাম ২ নম্বর ব্লকের রেয়াপাড়া শিবমন্দিরের মাঠে। ঘণ্টাখানেক অস্থায়ী আস্তানায় বিশ্রাম নিয়ে সোজা হুইল চেয়ারে চেপেই চলে এলেন মাঠের ‘বসন্ত উৎসব’ মঞ্চে। কপ্টারে তাঁর সঙ্গেই এসেছিলেন কীর্তন শিল্পী অদিতি মুন্সি। যে অদিতি নীলবাড়ির লড়াইয়ে রাজারহাট-গোপালপুর আসনের তৃণমূল প্রার্থীও বটে।
মঞ্চে উঠেই মমতা জানিয়ে দিলেন, রেয়াপাড়ায় এটা তাঁর কোনও রাজনৈতিক সভা নয়। এটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এখানে তিনি রাজনৈতিক কোনও বক্তৃতা করবেন না। তাঁর কথায়, ‘‘রাজনীতির কথা সব সময় আছে, থাকবে। এখন আমি আপনাদের প্রার্থী। চার-পাঁচ দিন থাকব। অদিতিকে নিয়ে এসেছি। আপনারা ওর গান শুনুন।’’ পরে যদিও অদিতির গান শেষে বসন্ত উৎসবের মঞ্চ থেকেই মমতা প্রায় আধঘণ্টা রাজনৈতিক কথাই বললেন। তোপ দাগলেন শুভেন্দু অধিকারী এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে। তুললেন বিস্ফোরক অভিযোগও।
বসন্ত উৎসবের মঞ্চ থেকে একের পর এক কীর্তন শোনান অদিতি। মুখ্যমন্ত্রীকে কীর্তনের ছন্দে হুইল চেয়ারের হাতলে তাল ঠুকতেও দেখা গেল। প্রথমে উৎসব প্রাঙ্গণ তেমন ভরে না উঠলেও অদিতির গানের সংখ্যা বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে মাঠও আস্তে আস্তে ভরতে থাকে। অদিতির গান শেষে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘ভেবেছিলাম, আজ এখানে আমি রাজনৈতিক বক্তব্য রাখব না। কারণ দোল একটা সাংস্কৃতিক উৎসব। ধর্ম যার যার আপনার। আর উৎসব আমাদের সকলের। নন্দীগ্রামের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব কী বলুন তো? ভূমি উচ্ছেদ আন্দোলনের সময় আপনারা সবাই মিলে একত্রিত ভাবে, কেউ আজানের ধ্বনি দিয়েছেন, কেউ শঙ্খধ্বনি দিয়েছেন, কেউ উলুধ্বনি দিয়েছেন। কিন্তু আপনারা কেউ নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি করেননি।’’
নন্দীগ্রামে মমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি-র শুভেন্দু অধিকারী। রবিবার রেয়াপাড়ার বসন্ত উৎসবের মঞ্চ থেকে মমতা নাম না করে শুভেন্দু তথা অধিকারী পরিবারের প্রতি একের পর এক কটাক্ষ শানিয়েছেন। করেছেন বিস্ফোরক অভিযোগও। তিনি বলেন, ‘‘আমার নিজের অনেক দোষ আছে। আমি নিজের দোষ স্বীকার করছি। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মতো অন্ধ ভালবাসা। কেউ পিছন থেকে ছুরি মারতে পারে আমি বুঝতে পারিনি। এরা কেউ তৃণমূলের জন্মলগ্নে ছিল না। বাবাও ছিল না, ব্যাটাও ছিল না, জ্যাঠাও ছিল না, কাকাও ছিল না।’’ এর পরেই মমতা নন্দীগ্রাম-আন্দোলনের সময়কার কথা তুলে বলেন, ‘‘যারা গুলি চালিয়েছিল আপনাদের মনে আছে, পুলিশের ড্রেস পরে এসেছিল অনেকে। মনে আছে? মনে পড়ছে? অনেকে পুলিশের ড্রেস পরে এসেছিল। নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। নন্দীগ্রাম নন্দীমা আমার মনে আছে সব। আমি ডেট ওয়াইজে বলে দেব। মনে আছে, হাওয়াই চটি পরে এসেছিল বলে ধরা পড়ে গেছিল। এ বারেও সেই সব কেলেঙ্কারি করছে। অনেক বিএসএফ, সিআইএসএফ-এর ড্রেস ট্রেস কিনেছেন। কারণ যাঁরা এ সব করে না তাঁরা জানেন। আর আমি এখনও বিশ্বাস করি আমি পরে শুনেছিলাম, এই বাপ-ব্যাটার পার্মিশন ছাড়া সে দিনকে পুলিশ নন্দীগ্রামে ঢুকতে পারত না। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি। আমিও একটা গভর্নমেন্ট চালাই। আমিও খোঁজ খবর পরে নিয়েছি। দেখুন আমি ভদ্রলোক বলে কিছু বলিনি। ফেয়ার এনাফ।’’
১ এপ্রিল নন্দীগ্রামে নির্বাচন। তার আগে শেষপর্বের প্রচারে নিজের কেন্দ্রে এসে বসন্ত উৎসবের মঞ্চকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করলেন মমতা। অদিতির গানের সঙ্গে দু’হাত উপরে তুলে গানের তাল দেওয়া জনতা, মুখ্যমন্ত্রী যখন এ সব কথা বলছেন তখন ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করেছে। আর মমতা যখন মঞ্চ থেকে দোল উৎসব প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত করে বলছেন, ‘নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল’, শিবমন্দিরের আকাশে তখন পূর্ণিমার সুডৌল চাঁদ আভা ছড়াতে শুরু করেছে।