উদয়ন গুহ, নিশীথ প্রামানিক, আব্দুর রউফ (বাঁ দিক থেকে)।
রাজার শহর ছাড়িয়ে সামান্য এগোতেই মেঠো পথ। চৈত্রের হাওয়া বইছে শনশন করে। ধূলিঝড় উঠছে ফাঁকা মাঠে। তার মধ্যেই মাঠ পেরিয়ে ভেসে আসছে স্লোগানের শব্দ। তবে সুর অস্পষ্ট। মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় ধরতেই পারবেন না, এই সুরের মধ্যে কী লুকিয়ে আছে— ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘জয় শ্রীরাম’, নাকি ‘খেলা হবে’।
কোচবিহারের রাজপাটে এমনই চোরা স্রোত। কথায়, সুরে।
রাজশাসন শেষ হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া প্রত্যন্ত অঞ্চল হিসেবেই পরিচিত কোচবিহার। বেশিরভাগ মানুষ কৃষিজীবী। কল-কারখানা বলতে কিছুই নেই। নেই কৃষিভিত্তিক শিল্পও। তাই বছরভর পরিযায়ী শ্রমিকদের ঢল গ্রাম, শহর, জেলা, রাজ্য পেরিয়ে অন্যত্র যায় কাজের খোঁজে। দেশের এমন কোনও রাজ্য খুঁজে পাওয়া ভার যে শিল্পাঞ্চলে কোচবিহারের মানুষ থাকেন না। দিল্লি-মুম্বই তো বটেই, পড়শি দেশ নেপাল-ভুটানেও অনেকে যান কাজের খোঁজে। এ বারের করোনা কালে সেই মানুষদের দুর্দশার কাহিনি সামনে এসেছে বারে বারে। সঙ্গে ঘুরে ঘুরে এসেছে একটা প্রশ্ন, তা হলে কি রাজ্যে শ্রমিকদের জন্যও কোনও কাজ নেই? কয়েক মাসের মধ্যে ভোট এসে পড়ায় প্রশ্নর জোর বেড়েছে আরও বহু গুণ।
অথচ, গ্রামের মানুষজন অনেকেই মেনে নিচ্ছেন, হয়েছেও কিছু কম নয়। আগে কোচবিহার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে হত শখানেক কিলোমিটার। এখন জেলাতেই
সুযোগ মিলছে উচ্চশিক্ষার। হয়েছে মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। তিস্তার উপরে ‘জয়ী’ সেতু একটানে ৬০ কিলোমিটার পথ ছেঁটে ফেলেছে হলদিবাড়ির সঙ্গে কোচবিহার শহরের।
সীমান্ত ঘেঁষেই গ্রাম পোয়াতুর কুঠি। একসময়ের সাবেক ছিটমহল। দিনহাটা বিধানসভার মধ্যে পড়া ওই এলাকার বাসিন্দা যুবক সাদ্দাম হোসেন থেকে বৃদ্ধ মনসুর আলি বলছেন, “অনেক কিছুই পেয়েছি, অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। এই সরকারের আমলেই ছিটমহল বিনিময় হয়েছে। গ্রামে রাস্তা হয়েছে। করোনার সময় থেকে রেশনে চাল-গম পাচ্ছি।” এই সুর অবশ্য পাল্টে যায় দিঘলটারিতে। গ্রামের বাসিন্দা মানিক সেন, ফনী সেনরা বলেন, “শৌচাগারের জন্য আমাদের কাছে দু’হাজার টাকা করে নিয়েছে। কয়েকটি ইট গেঁথে কাজ শেষ করা হয়েছে।” গ্রামের সামনের রাস্তা দেখিয়ে তাঁদের আক্ষেপ, “এই রাস্তার কাজ কেউ করে দেয়নি।”
দিনহাটায় শাসকদলের প্রার্থী উদয়ন গুহ। ফরওয়ার্ড ব্লকের দোর্দন্ডপ্রতাপ নেতা কমল গুহের পুত্র। ২০১৬ সালের বিধানসভার আগে তৃণমূলে যোগ দেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ওই এলাকার পুরনো তৃণমূলীদের দ্বন্দ্বের কথা শিশুরাও জানে। উল্টো দিকে প্রার্থী একদা তৃণমূলের যুব নেতা এবং এখন বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক। ফলে চাপ বেড়েছে উদয়নের।
ঘরোয়া দ্বন্দ্বের ছায়া পড়েছে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষের খাসতালুক নাটাবাড়িতেও। সেখানেও বিজেপির প্রার্থী এক প্রাক্তন তৃণমূলী, মিহির গোস্বামী। শাসকদলেরই কয়েক জন কর্মীর কথায়, “মিহিরকে তো ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল বিজেপিতে। এখন পরীক্ষা কঠিন বললে চলবে কেন?’’ এ কথা মেনে নিচ্ছেন আব্দুল জলিল আহমেদের মতো প্রবীণ তৃণমূল নেতাও। তাঁর কথায়, “দ্বন্দ্বের জন্যই আমাদের সংগঠন অনেক জায়গায় দুর্বল হয়েছে।” শীতলখুচিতে প্রবীণ বিধায়ক হিতেন বর্মণকে সরিয়ে তরুণ মুখ পার্থপ্রতিম রায়কে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। মেখলিগঞ্জেও অর্ঘ্য রায় প্রধানকে সরিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে একসময়ের বাম মন্ত্রী পরেশ অধিকারীকে। তুফানগঞ্জে ফজল করিম মিয়াকে সরিয়ে মানিক দে প্রার্থী। তাতে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ নেতা সাবির সাহা চৌধুরী বলেন, “আসল সমস্যাকে লুকিয়ে রাখার ফল কোথাও ভাল হয়নি।” সদ্য বিজেপিতে যোগ দেওয়া সিতাইয়ের বিবেক ভদ্র বলেন, “আসলে স্বচ্ছ মানুষের জায়গা নেই তৃণমূলে।” মিহিরের কথায়, “অর্থ যেখানে প্রধান ও একমাত্র বিষয় হয়ে ওঠে, সেখানে সুস্থ পরিবেশ থাকে না। তাই দ্বন্দ্ব থামার সুযোগ নেই।”
দলের জেলা সভাপতি পার্থ অবশ্য বলেন, “দ্বন্দ্ব নেই। এখন পরিষ্কার দু’পক্ষ। যে তৃণমূলের হয়ে মাঠে নামবে না, তাঁকে আমরা বিরোধীপক্ষ ধরেই এগোব।”
তৃণমূল থেকে স্রোত তাই বিজেপির দিকে। এবং তাতে গেরুয়া শিবিরেও দ্বন্দ্বের নতুন রং ধরেছে। প্রার্থী ঘোষণার পর তা প্রকাশ্যেও এসেছে। তবে তা এক-দু’টি কেন্দ্র বাদে তা প্রকট নয়। তবু তৃণমূল তাতে খোঁচা দিতে ছাড়েনি। নাটাবাড়িতে প্রচারের কাজ করছেন তৃণমূলের জয়হিন্দ বাহিনীর নেতা প্রবাল গোস্বামী। তাঁর কথায়, “উন্নয়নের নিরিখে ভোট হলে বিজেপি বা বাম জোট, কেউ একটি আসনও পাবে না। আর বিজেপি কাদের প্রার্থী করেছে? যাদের বিরুদ্ধে মুঠো মুঠো দুর্নীতির অভিযোগ। সে জন্যেই তো ধর্মীয় উদ্মাদনা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
বস্তুত, কাজের খতিয়ান শুনিয়ে যাওয়া নেতাও পার্টি অফিসে ঘরোয়া আলোচনায় এই একটি ভয় পাচ্ছেন। কারণ, বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বলে বরাবরই এই জেলায় মেরুকরণ ছিল। বিজেপির একটা ভোটব্যাঙ্কও ছিল বরাবর। পার্থপ্রতিম যখন কোচবিহার লোকসভা আসন থেকে উপনির্বাচনে জেতেন, তখন দ্বিতীয় স্থানে ছিল বিজেপি। তৃণমূলের এখানেই ‘খেলা শেষের’ ভয়।
জাতপাতের হিসেব অবশ্য সব দলই করছে। এ বারের লোকসভার ফল অনুযায়ী, বিজেপি ৪৭.৯৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে কোচবিহারে। তৃণমূলেরও ভোট ২০১৬ বিধানসভার তুলনায় বেড়েছে এক শতাংশ। সব মিলিয়ে ৪৪.৪৩ শতাংশ। বামেদের ভোট তলানিতে ঠেকেছে, ৩.০৭ শতাংশ। কংগ্রেস পেয়েছে ১.৮৫ শতাংশ। এই জেলায় তফসিলি ভোটের সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ। যার সংখ্যাধিক্য রাজবংশী। যে ভোট নিয়ে টানাটানি চলছে। সংখ্যালঘু ভোটের সংখ্যা প্রায় ২৭ শতাংশ।
এই ভোটের অধিকাংশই রয়েছে তৃণমূলের সঙ্গে।
গ্রেটার কোচবিহার নেতা বংশীবদন বর্মণকে মাঠে নামিয়েছে তৃণমূল। দিদির কাজের ফিরিস্তি শুনিয়ে তিনি বলছেন, “তাই আমরা দিদির সঙ্গে।” আরেক গ্রেটার নেতা অনন্ত রায় (মহারাজ) রয়েছেন অন্তরালে। তাঁর সঙ্গে বিজেপির সখ্য। অমিত শাহ রথযাত্রার উদ্বোধন করতে এসে অসমে অনন্তর বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। অনন্ত বিজেপিকেই ভোট দিতে বলছেন।
মনীষী পঞ্চানন বর্মা, ভাওয়াইয়া কিংবদন্তি আব্বাসউদ্দিনের জেলায় হয়তো কস্মিনকালে কেউ ভাবেনি, এমন ভাগে ভাগ হবে ভোট। এখন সেটাই হচ্ছে।
এবং এই ভোটের ভাগাভাগিতেই এখন লুকিয়ে আছে রাজার জেলায় রত্ন ভাণ্ডার দখলের চাবিকাঠি।