গ্রামের বাড়িতে রেজ্জাক।
রাজ্য রাজনীতি এক সময়ে তোলপাড় হয়েছিল তাঁর মন্তব্যে। ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটের ফল ঘোষণার দিন সিঙ্গুর প্রসঙ্গে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনকে কটাক্ষ করে ‘চাষার ব্যাটা’ বলেছিলেন, ‘হেলে ধরতে পারে না, গিয়েছে কেউটে ধরতে।’
কাঁধে গামছা ফেলে তাঁর সেই বেপরোয়া, একরোখা, ঠোঁটকাটা ভাবমূর্তি এখনও মানুষের মনে টাটকা। তবে মূলত যাঁকে উদ্দেশ্য করে কটাক্ষ করেছিলেন রেজ্জাক, সেই বুদ্ধবাবু এবং তিনি নিজেও এখন ভোটের রাজনীতি থেকে বহু দূরে। একজন শারীরিক অসুস্থতার জন্য যেতে পারেননি ব্রিগেডে সংযুক্ত মোর্চার সমাবেশে। তাঁর এক সময়ের সতীর্থ রেজ্জাকও বয়সের ভারে গৃহবন্দি। এ বার দল প্রার্থী করেনি তাঁকে। তাঁর পুরনো দল সিপিএম কিংবা বর্তমান দল তৃণমূলের কেউ দেখতেও আসে না এখন, ভারাক্রান্ত মুখে বলেন প্রবীণ নেতা। তবে কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, সুভাষ নস্করদের মতো বাম জমানার পুরনো সতীর্থদের সঙ্গে তিনি নিজেও দেখা করতে যেতে পারেন না বলে আফসোস আছে।
ছাত্র রাজনীতির মধ্যে দিয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি ভাঙড়ের বাঁকড়ি গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান রেজ্জাকের। তৎকালীন সিপিএমের জেলা নেতা শিবদাস ভট্টাচার্যের হাত ধরে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ। ১৯৭২ সালে ভাঙড় কেন্দ্র থেকে সিপিএমের টিকিটে জিতে বিধায়ক হন। ১৯৭৭ সাল থেকে তিনি ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা থেকে সিপিএমের প্রার্থী। ২০১১ সাল পর্যন্ত সিপিএমের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন।
২০১১ সালে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরে রেজ্জাক বার বার দল বিরোধী মন্তব্য করতে থাকেন। ২০১৪ সালে সিপিএম তাঁকে বহিষ্কার করে। ‘ন্যায়বিচার পার্টি’ তৈরি করে সামাজিক আন্দোলনে সামিল ছিলেন কিছু দিন। ২০১৬ সালে তৃণমূলে যোগ দেন। ওই বছরই তৃণমূলের টিকিটে জেতেন ভাঙড়ে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের দায়িত্বও পান।
ভাঙড়ে দাঁড়িয়ে এক সময়ে বলেছিলেন, সিন্ডিকেট রাজ, তোলাবাজি বন্ধ করে দেবেন। ব্যাটে-বলে ওভার বাউন্ডারি হাঁকাবেন বলে বাহবা কুড়োন। কিন্তু তাঁর আমলে ভাঙড়ে সিন্ডিকেট রাজ, তোলাবাজি বন্ধ হয়নি বলে অভিযোগ। উল্টে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলনের সময়ে জমি কমিটি অভিযোগ করেছিল, গ্রিড তৈরি হলে মহিলারা সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারাতে পারেন। সে সময় রেজ্জাক মোল্লা তৎকালীন তৃণমূলের জেলা সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায়কে পাশে বসিয়ে পাওয়ার গ্রিড এলাকায় এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘‘যাদের বাচ্চা হবে না, তাদের হাইব্রিড বাচ্চা দেওয়া হবে।’’ সেই মন্তব্য নিয়েও সমালোচনার ঝড় ওঠে।
২০১৬ সালে ভোটে জেতার পরে এলাকায় সে ভাবে সময় দেননি বলে অভিযোগ। বছরখানেক ধরে শারীরিক অসুস্থতার কারণে ভাঙড়ে দেখাই যায়নি আশি বছরের বৃদ্ধ নেতাকে।
শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে এ বার ভোটে লড়বেন না বলে দলনেত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন রেজ্জাক। দীর্ঘ দিন ধরে ভুগছেন কিডনির অসুখে। চোখে সমস্যা আছে। হৃদরোগ আছে। সম্প্রতি পা ভেঙে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে বা হাঁটাচলা করতে পারেন না। লাঠি বা হুইল চেয়ার সঙ্গী। নিউটাউনে ফ্ল্যাট আছে। তবে ভাঙড়ে দেশের বাড়িতেই থাকেন বেশিরভাগ সময়। ইস্রাফিল নামে এক যুবক দেখাশোনা করেন।
নিজেকে ‘চাষার ব্যাটা’ বলতে ভালবাসতেন বরাবর। চিরকাল কথার ঝাঁঝ এবং রসিকতায় দড়। এখনও সেই মেজাজটা টোল খায়নি। দলের কেউ খোঁজ-খবর করে না, জানান রেজ্জাক। আর বলেন, ‘‘তৃণমূলে ও সবের কালচারই নেই।’’
তবে মুখ্যমন্ত্রীর উপরে এখনও অগাধ ভরসা রেজ্জাকের। দ্রুত আরোগ্য কামনা করে রেজ্জাক বলেন, ‘‘উনি রাজ্যের কর্ণধার। রাজ্যের স্বার্থেই ওঁর সুস্থ হওয়া জরুরি।’’
দিনের অনেকটা সময় খবরের চ্যানেলে চোখ রাখেন বলে জানালেন। খবরাখবর পান সেখান থেকেই। সংযুক্ত মোর্চার ভবিষ্যৎ তেমন উজ্জ্বল নয় বলেই মনে করেন বর্ষীয়ান নেতা। মমতাই ফের সরকার গড়বে, বিশ্বাসে অটল ‘চাষার ব্যাটা।’
—সহ প্রতিবেদন: সামসুল হুদা