শুনশান: ভোটের আগের দিন বো ব্যারাক চত্বর। বুধবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
আজন্ম শুদ্ধ শাকাহারী তিনি। কিন্তু কচ্ছের গুজরাতি পরিবারে জন্মানো ‘ক্যালকাটান’ আশিস শাহের কাছে প্রিয় বন্ধু বলতে সরফরাজ, গুলাম মহম্মদ বা অ্যান্ড্রু, ন্যাথানিয়েলদের নামটাই সবার আগে মনে পড়ে। বুধবার সন্ধ্যায় বাংলার ভোট-অষ্টমীর প্রাক্কালে হাসতে হাসতেই আশিস বলছিলেন, ‘‘বন্ধুরা একসঙ্গেই ভোট দিতে যাই। বৌবাজার পোস্ট অফিসের উল্টো দিকে আমাদের বুথের ভোটার-তালিকায় বিচিত্র নাম দেখে কত ‘পোলিং অফিসার’ও তাজ্জব বনে যান।’’
বাংলার ভোটপর্বের এই শেষ দফাতেই বুথমুখো হবে এক চিরন্তন কলকাতা, যা শহরের সবাইকে নিয়ে চলার আদর্শকে সগৌরবে ধারণ করে আসছে। উত্তর ও মধ্য কলকাতার ভোট মানে শুধুই সাবেক শহরের ‘বাঙালি বাবুদের’ ভোট নয়। শ্যামপুকুর, মানিকতলার গা ঘেঁষে জোড়াসাঁকো ও চৌরঙ্গি কেন্দ্র বলতে ব্রিটিশ আমলের ‘গ্রে টাউন’। খাঁটি শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় বা বাঙালিদের তল্লাটের মধ্যবর্তী এই এলাকায় বরাবরই মিশে দুনিয়ার পাঁচমিশেলি সংস্কৃতি। ইহুদি বা আর্মেনিয়ানদের সংখ্যা এখন তলানিতে। তবে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, চিনে, পার্সি, উত্তর ভারতীয় থেকে উর্দুভাষী মুসলিমেরা এখনও এ শহরের রঙিন ফুলদানির এক-একটি ফুল। বড়দিনে বো ব্যারাক চত্বরে আলোর ঝালর দেখতে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোটা কলকাতা বা দূরের মফস্সলও। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভোটের আগের দিন সেই বো ব্যারাক চত্বরই আশ্চর্য থমথমে। বিকেলের ফুচকাওয়ালা থেকে পর্ক বাও, ফিশ বল সুপের পসরা সাজানো ‘কালো মেমসাহেবদের’ দেখা নেই। গত চার দশক ধরে এ তল্লাটের বাসিন্দা ভগবৎ জানা বলছিলেন, “লোকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের পাড়া বলে জানলেও এটা একেবারেই মিনি ইন্ডিয়া। আমি মেদিনীপুর থেকে এসে সিপিআইয়ের গীতা মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়দের বাড়িতে থাকা শুরু করি। চিনে পড়শির নতুন রেস্তরাঁ উদ্বোধন, ভিন্ ধর্মের বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে সংস্কৃতির একটা আলাদা স্বাদ পাই।”
তিনি দেখেছেন, সাবেক বৌবাজার কেন্দ্রের অন্তর্গত তল্লাটের কংগ্রেসি মেজাজে একদা বাম অনুরাগও ভাগ বসিয়েছিল। অফিস-ফেরত গ্লেন্ডা রিজকুক তখনই বলে ওঠেন, ‘‘এখন আবার তৃণমূলেরই হাওয়া!’’ তবে সংস্কৃতির খোলা হাওয়া বইলেও রাজনীতির হাওয়া তত প্রকাশ্য আলোচনার বিষয় নয়, বলছিলেন গুজরাতি তরুণ আশিস। তবে স্থানীয় বিদায়ী কাউন্সিলরের সঙ্গে সবার সদ্ভাব। আশিসের কথায়, “এখানে নানা গোষ্ঠী ও ভিন্ধর্মীদের সঙ্গে মিশতে পারা একটা অ্যাডভান্টেজ। মনটা অনেক খোলা হয়! দেশের অন্যত্র যা-ই ঘটুক, এই পাড়াতেই নিজেকে সব থেকে সুরক্ষিত লাগে।”
বো ব্যারাকের মতোই অতিমারির গুমোট পাশের টেরিটিবাজারের চিনেপাড়া বা ঘিঞ্জি গলির কলুটোলায়। টেরিটিবাজারের চিনে রেস্তরাঁর কর্ণধার, সুখী-সুখী চেহারার অনুচ্চ যুবক কুচি চোইয়ের ভোট হরিণবাড়ি এলাকায়, পাশের জোড়াসাঁকো কেন্দ্রে। বৌবাজার, জোড়াসাঁকোর এই এলাকাগুলোয় বিজেপি প্রার্থীদের ততটা দেখা মেলেনি। তুলনায় তৃণমূল বা সংযুক্ত মোর্চা সমর্থিত কংগ্রেসই বেশি দৃশ্যমান। ছুটির মেজাজে দুপুরের দিকে হেলতে-দুলতে ভোটটা দিয়ে আসার পরিকল্পনা কুচির।
শেষ দফার ভোটের মতো রমজানের কৃচ্ছ্রসাধন শেষে ইদের প্রস্তুতিও এ বার খানিক ধাক্কা খেয়েছে কলকাতার এই অংশে। তবে জান মহম্মদ স্কুলের বুথে ভোটটায় ফাঁকি দিতে চান না শতাব্দী-প্রাচীন হাজি আলাউদ্দিনের মিষ্টি-নোনতার ঘরের ছেলে ইজাজ আহমেদ। দোকানে ইফতারির খাবার বিক্রিতেও এখন দূরত্ব রেখে লাইন। তদারকি করতে করতে বিকেলে কথা বলছিলেন। সানাইয়ের কিংবদন্তী বিসমিল্লা খান সাহেবের বেয়াই সাজ্জাদ হুসেনের পুত্র আহমেদ হুসেনও ওই বুথেই ভোট দিতে যাবেন। প্রয়াত সাজ্জাদ হুসেনের আর এক ছেলের স্ত্রী, বিসমিল্লা খান সাহেবের কন্যা আজরা বেগম কলুটোলাতেই থাকেন। তবে এই সময়টা বারাণসীতে আটকে পড়েছেন। আহমেদ হুসেন বলছিলেন, ‘‘ভোট পাঁচ বছরে এক বার আসে! কিন্তু এ পাড়ায় সবার মধ্যে বেরাদরির মেজাজ চিরকালের। সেটার পরিবর্তন নেই।’’