মীনাদেবী পুরোহিত, বিবেক গুপ্ত এবং আজমল খান।
উত্তর কলকাতার পরিচিত দালান বাড়ির সামনে বসে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন অশীতিপর বৃদ্ধ। পাশেই আপন মনে খেলে চলেছে তাঁর বছর পাঁচেকের নাতনি। কাগজ পড়তে পড়তে পুরু কাচের চশমার উপর দিয়ে পাশের আর এক বৃদ্ধকে বললেন, ‘‘ভোট ভোট তো করছিস! কাগজপত্র আছে তো?’’ মৃদু হেসে অপর বৃদ্ধের উত্তর, ‘‘আর কাগজ! আমার জীবন তো শেষ।’’ কিন্তু তোর ছেলেমেয়ের? বৃদ্ধের পাল্টা প্রশ্নে চুপ হয়ে গেলেন পাশের জন। যদিও পাশে বসা নাতনিটির এ সব কথায় ভ্রুক্ষেপ নেই। আপন মনে খেলেই
চলেছে সে।
জোড়াসাঁকো কেন্দ্র তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি বলেই পরিচিত। ২০০১ সাল থেকেই জোড়াসাঁকো কেন্দ্রটি নিজেদের দখলে রেখেছে তৃণমূল। এ বার এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী করেছে ব্যবসায়ী বিবেক গুপ্তকে। অন্য দিকে, বিজেপি ভরসা রেখেছে কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর মীনাদেবী পুরোহিতের উপরে। মীনাদেবী এক সময়ে কলকাতা পুরসভার ডেপুটি মেয়রও ছিলেন। এ ছাড়া, তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ভোটের ময়দানে রয়েছেন সংযুক্ত মোর্চা সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী আজমল খান।
প্রথম দিন থেকেই ‘পাড়ার ছেলে’ হিসেবে প্রচার করছেন তৃণমূল প্রার্থী বিবেক। প্রচারে বিশেষ ট্যাবলো, একাধিক গাড়ি, হাজার হাজার কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে মিটিং-মিছিলের পরিবর্তে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারেই স্বচ্ছন্দ তিনি। ‘‘আমি যে পাড়াতেই যাচ্ছি, সেখানেই ভোটারেরা বলছেন, এটা তো আপনার পাড়া! আপনি এখানে কেন প্রচার করে সময় নষ্ট করছেন! বরং অন্য দিকে প্রচার করুন। মানুষের এই ভালবাসাই আমাকে বাড়তি ভরসা দিচ্ছে।’’— আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছেন বিবেক।
অন্য দিকে, বিজেপি প্রার্থী মীনাদেবীও প্রচারে গিয়ে ভোটারদের উন্মাদনা দেখে আত্মবিশ্বাসী। তাঁর কথায়, ‘‘আমি ২৫ বছর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। প্রচারে গিয়ে ভোটারদের চোখ-মুখ আমায় পাল্টা আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে।’’
ব্যবসায়িক সূত্রে দীর্ঘ দিন ধরে জোড়াসাঁকো এলাকার সঙ্গে পরিচিত তৃণমূল প্রার্থী। নিজেই জানালেন সে কথা। বিবেকের কথায়, ‘‘কাজের সূত্রে দীর্ঘ দিন ধরে আমি এই এলাকার সঙ্গে যুক্ত। বছরভর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমায় সকলে ডাকেন এই এলাকায়। এলাকার এবং ব্যবসায়ীদের ভাল-মন্দ বা তাঁদের সমস্যা সম্বন্ধে আমি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। ২ মে-র পরে সেই সব সমস্যার সমাধানে কাজ করতে চাই। পাশাপাশি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি নিয়েও পরিকল্পনা রয়েছে।’’ ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়ার কথা শোনা গেল বিজেপি প্রার্থীর মুখেও। তবে এর জন্য ইতিমধ্যেই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছকে ফেলেছেন বিবেক। জানালেন, ঠাকুরবাড়িকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট বানানোর কথা। বিশ্ব মানচিত্রে জোড়াসাঁকোকে তুলে ধরাই যে তাঁর আসল উদ্দেশ্য— সে কথাও জানাচ্ছেন তিনি।
এলাকার সমস্যাগুলির কথাও কারও অজানা নয়। বেনিয়াটোলা লেনের বাসিন্দা দিলীপ সিংহ এলাকার একের পর এক সমস্যার কথা তুলে ধরছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বেহাল নিকাশি ব্যবস্থা, যানজট, বেআইনি পার্কিং জোড়াসাঁকো ও সংলগ্ন এলাকার বড় সমস্যা। গরমের সময়ে পানীয় জলের সমস্যা দেখা দেয়। তার সঙ্গে রয়েছে কর্মসংস্থানের সমস্যাও। যুবকদের যিনি দিশা দেখাতে পারবেন, তাঁর দিকেই পাল্লা ভারী হবে।’’ বড়বাজার এলাকার বাসিন্দা, বছর তিরিশের রামপ্রসাদ আবার বললেন, ‘‘কাছেই বড়বাজার এলাকা, কিন্তু স্থানীয়েরাই কাজ পান না। সবাইকে বাইরে যেতে হয় কাজের জন্য।’’ আক্ষেপের সুর শোনা গেল তাঁর গলায়। এলাকার বাসিন্দাদের কারও কারও কথায় এনআরসি নিয়েও চাপা আতঙ্ক দেখা গেল।
এলাকার এই সব সমস্যার পাশাপাশি অন্যান্য সমস্যার কথা যে প্রার্থীরা জানেন না, তা নয়। বিবেক বলছেন, ‘‘জোড়াসাঁকো বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যেই রয়েছে বড়বাজার এলাকা, যা ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র। এখানে পার্কিংয়ের সমস্যা রয়েছে।’’ একই সমস্যার কথা শোনালেন মীনাদেবী এবং আজমলও। বিজেপি প্রার্থীর দাবি, ‘‘এই সমস্যার কথা তুলে আমি অনেক বার পুরসভায় সরব হয়েছিলাম। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করেননি।’’ তবে এলাকার পার্কিং সমস্যার সমাধানে বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়ে বিবেক বলছেন, ‘‘ব্যবসায়ী, প্রশাসন, এলাকার মানুষদের নিয়ে কমিটি করে এই সমস্যা সমাধানে পরিকল্পনা করেছি। আশা করি, এ বার সমাধান করতে পারব।’’
অন্য দিকে, বেকারদের কর্মসংস্থান, এলাকায় জল জমা, পানীয় জলের সমস্যা-সহ একাধিক বিষয়কে ‘হাতিয়ার’ করেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারে মন দিয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী আজমল। জোটসঙ্গী বাম কর্মীরাও তাঁকে সাহায্য করছেন বলে জানাচ্ছেন তিনি। আর প্রচারে গিয়ে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পরিষেবা এবং বড়বাজার এলাকায় পার্কিং সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আজমল বলেন, ‘‘আমার বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার শেষ। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের সমস্যা জানার চেষ্টা করেছি।’’ তবে ভোটের ফলাফল নিয়ে কংগ্রেস প্রার্থী আশাবাদী হলেও এলাকায় ভগ্নপ্রায় দলীয় সংগঠন চিন্তায় রাখবে তাঁকে।
২০০১ সাল থেকেই জোড়াসাঁকো কেন্দ্রটি তৃণমূলের দখলে। ২০১১ এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূলের স্মিতা বক্সী। কিন্তু ২০১৯-এর
লোকসভা ভোটে দেখা যায়, এই কেন্দ্রে বিজেপির থেকে পিছিয়ে শাসক দল। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এই এলাকার হিন্দিভাষী ভোটারদের একটা বড় অংশের সমর্থন লোকসভা ভোটের সময়ে বিজেপির দিকে গিয়েছিল। একুশের ভোটে সেই ভোটারদের ফিরিয়ে আনতে তাই বিবেককে প্রার্থী করেছে তৃণমূল।
শাসক দলের এই অঙ্ক অনেকাংশে সফল হবে বলেই মনে করছেন এলাকার ভোটারদের একাংশ, যা স্বস্তি দিচ্ছে ঘাসফুল শিবিরকে।