Barrackpore

WB Election: বোমা-গুলি নয়, বন্ধ কারখানার ভোঁ ফের শুনতে চায় এলাকা

Advertisement

সুব্রত বসু

ব্যারাকপুর শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২১ ০৫:২১
Share:

বিক্ষোভ: শ্যামনগরের ওয়েভারলি জুটমিলে শ্রমিকদের রাস্তা অবরোধ —ফাইল চিত্র

প্রায় তিনশো বছর ধরে বাঙালির মুখে ঘুরছে এই গান― ‘এমন মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা....’

Advertisement

ব্যারাকপুর মহকুমার হালিশহরের ভিটেয় বসে লিখেছিলেন রামপ্রসাদ সেন।

হালিশহরের কয়েক কিলোমিটার আগে শ্যামনগরের ঘোষপাড়া রোডে ওয়েভারলি জুটমিল। মিলের সামনেই একটি সাইকেল সারানোর দোকানে বসে রামদয়াল দুবে, আসগর আলিরা। জুটমিলের মতোই ক্ষয়াটে চেহারা, তোবড়ানো গাল। “পাঁচ মাস মিল বন্ধ। রোজগার নেই হাজার চারেক মজদুরের। বাচ্চাদের খাওয়ানোর টাকাও শেষ।’’― বলেন রামদয়াল। আসগর বললেন, ‘‘ভুখা পেট দোজখ (নরক) হোতা হ্যায়। ইয়ে জাহান্নম খতমই নাহি হোতা।’’

Advertisement

বিটি রোডের ধার দিয়ে সরু অলিগলি হয়ে লুমটেক্স জুটমিলের মজদুর বস্তি। গিজগিজে ভিড় রাস্তায়। প্রতিটি ল্যাম্পপোস্ট বা উঁচু জায়গায় ঝুলছে বিজেপি আর
তৃণমূলের পতাকা, প্রার্থীদের কাটআউট। লুমটেক্সের শ্রমিক কালী হেলা বলেন, ‘‘হপ্তায় কখনও দু’দিন, কখনও তিন দিন কাজ মেলে।’’ ভিড়ের মধ্যে থেকেই সুরজ পাসোয়ান বলেন, ‘‘শিফটের সময়ে ভোঁ (সাইরেন) বাজলে বুকে একটা জোর পেতাম। বুঝতাম, কাজ থাক বা না থাক, মিলটা অন্তত চালু আছে! এখন আর সেই বাঁশি বাজে না। কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হলে বলবেন, বাঁশিটা আগের মতো যেন বাজানো হয়।’’ প্রায় বন্ধ মিলের বাঁশি শোনার আকুতি শুনে চুপ করে যান সবাই।

কারখানার বাঁশি নেই। তবে, শব্দ প্রবল ভাবে আছে এই শিল্পাঞ্চলে। সেই শব্দে নিরাপত্তার অভাব এতটাই প্রকট যে ঘরের
দরজা-জানলা বন্ধ করে কাঁপতে থাকেন মানুষ। ঘোষপাড়া রোড ধরে ঢুকে পড়ুন ভাটপাড়ায়। আপনি পৌঁছে গেলেন সাম্প্রতিক কালে রাজ্যের সব চেয়ে ‘উপদ্রুত’ এলাকায়। গত লোকসভা ভোটের পর থেকেই এই এলাকার মানুষ,
সকাল-সন্ধে বোমা-গুলির শব্দের সঙ্গেই ঘর করেন। হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায় স্কুল, দোকানপাট। তবে ‘দোজখের দৃশ্য’-র ভিডিয়ো দেখালেন এলাকার এক চিত্র সাংবাদিক।
ভিডিয়োটিতে দেখা যাচ্ছে, ১২-১৪ বছরের একদল বালক দমাদ্দম বোমা ছুড়ে চলেছে। উল্টো দিকে পুলিশ। মানবজমিনে এমন আবাদ দেখলে কী বলতেন রামপ্রসাদ, তা তিনিই জানেন!

ভাটপাড়ার কাছেই কাঁকিনাড়ায় মস্ত বাজার। সেখানকার এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘গোলমালের জেরে গত বছর ইদে ব্যবসা লাটে উঠেছিল। এ রকম চললে পথে বসব। নেতাদের অনুরোধ, এলাকার শান্তিটুকু ফিরিয়ে দিন।’’

এটাই মূল চাওয়া ভাটপাড়া-সহ শিল্পাঞ্চলের ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্রের বাসিন্দাদের। শান্তি ফিরলে, কাজ ফিরবে। কিন্তু শান্তি ফেরাবে কে? ব্যারাকপুরের এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘এখানে অপরাধী বলে কিছু হয় না। সবাই কোনও না কোনও রাজনৈতিক নেতার ছত্রচ্ছায়ায় আছে। অনেকটা বিহার-উত্তরপ্রদেশের মতো।’’ তাই পুলিশও এদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে। রাতে অনেক সময়েই দেখা যায়, পুলিশের গাড়ির পাহারাতেই সরিয়ে ফেলা হচ্ছে বন্ধ কারখানার যন্ত্রপাতি।

তৃণমূলে থাকার সময়ে অর্জুন সিংহ ছিলেন শুধু ভাটপাড়ার বিধায়ক। দল বদলে তিনি এখন বিজেপি-র প্রবল
পরাক্রমশালী সাংসদ। লোকসভা ভোটে নোয়াপাড়া ছাড়া এখানকার সব ক’টি কেন্দ্রেই তৃণমূলের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। জেতার পরে তাঁর সমর্থকেরা একের পর এক দখল করেছিল তৃণমূলের পার্টি অফিস ও পুরসভা। ছেলে পবনকে ভাটপাড়ার বিধায়ক করে এবং
নোয়াপাড়ার বিধায়ক ভগ্নিপতি সুনীল সিংহকে বিজেপি-তে টেনে শক্তি বাড়িয়েছেন অর্জুন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া তৃণমূলের দরকার ছিল অর্জুন সিংহের সঙ্গে ‘পাঙ্গা’ নেওয়ার মতো শক্তপোক্ত মানুষের। তাই অর্জুনের বিরোধী হিসেবে সুবোধ অধিকারীকে রাখা হল সামনে। ভোটের প্রচারের ফাঁকে নিজের অফিসে বসে সুবোধ বলেন, ‘‘আমি বিজেপি-তে ছিলাম। অর্জুনের বিরুদ্ধে আমার লড়াই। সেই অর্জুন বিজেপি-তে ঢুকতেই আমাকে তৃণমূল শিবিরে আসতে হল।’’ ফলে অর্জুনের দখলে চলে যাওয়া হালিশহর, কাঁচরপাড়া, নৈহাটি, ভাটপাড়া পুরসভা ফের কব্জায় আনলেন সুবোধ। এলাকায় তাঁর নাম, ‘রিকভারি এজেন্ট’। অর্জুনের দখলে চলে যাওয়া পার্টি অফিসগুলোও ‘রিকভার’ হল অনেকটাই। ইনাম হিসেবে দল সুবোধকে প্রার্থী করেছে বীজপুরে। তাঁর বিপরীতে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতা মুকুল রায়ের ছেলে শুভ্রাংশু। আসন ‘রিকভারির’ মস্ত চ্যালেঞ্জ নিয়ে দিনরাত খাটছেন সুবোধ, তাঁর পুরনো দল
বিজেপির বিরুদ্ধে। আর শুভ্রাংশু বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাচ্ছেন, তাঁর পুরনো দল তৃণমূলকে একটি ভোটও না দিতে।

শুধু সুবোধই নন, অর্জুনের এক সময়ের ‘ডান হাত’ বিজেপির অরুণ ব্রহ্মও এখন তৃণমূলে। সম্প্রতি দল ছাড়ার আগে শ্যামনগরে বিজেপি অফিসটি তিনি কার্যত ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। তৃণমূলের দাবি, গোটা শিল্পাঞ্চলে এখন ঘর অনেকটা গুছিয়ে নেওয়া গিয়েছে। মিটিং-মিছিল-জনসভার ভিড়ও সে কথাই বলছে। তবে দু’দলের সক্রিয় সমর্থকেরাও কে কখন বিজেপি, কে তৃণমূল— তা ঠাহর করতে হিমশিম খেতে হয় মানুষকে। সাদাকালো যুগের মহম্মদ রফির সেই বিখ্যাত গান মনে পড়ে যায়, ‘এক দিলকে টুকরে হাজার হুয়ে, কহি ইঁহা গিরা, কহি উঁহা গিরা...।’

যে যে দিকেই থাক, ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের অধীন প্রায় সব ক’টি বিধানসভা আসনে অর্জুনই কার্যত মূল প্রতিপক্ষ তৃণমূলের। বীজপুরে অবশ্য শুভ্রাংশু
অর্জুনের ছায়া থেকে বেরিয়ে কব্জির জোরেই লড়ছেন। নৈহাটির জাঁদরেল তৃণমূল প্রার্থী পার্থ ভৌমিকের ভাবমূর্তিই তাঁর প্লাস পয়েন্ট। রাজনীতির ময়দানে নেমে ব্যারাকপুরের তৃণমূল প্রার্থী রাজ চক্রবর্তীও সেই ভাবমূর্তির ভরসাতেই রয়েছেন। তবে তাঁর বিপরীতে বিজেপিতে রয়েছেন সম্প্রতি গুলিতে নিহত মণীশ শুক্লর বাবা চন্দ্রমণি শুক্ল। সেখানেও দাপটের গল্প। আর মণীশের গড়ে ভাঙন ধরানো যে রীতিমতো শক্ত কাজ, তা ভালই বুঝছেন রাজ। পাশাপাশি গোটা শিল্পাঞ্চলে রয়েছে
বাঙালি-অবাঙালি প্রচারের চোরাস্রোত। বিজেপি অনেকটাই ভরসা রেখেছে তাতে। এর পিছনেও রয়েছে অর্জুনের দাপট।

ব্যারাকপুরে দাপটের কথা হবে আর তাতে থাকবেন না প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ তড়িৎ
তোপদারের নাম, তা হয়? সকালে একদফা প্রচার সেরে পড়ন্ত বিকেলে প্রবীণ তড়িৎবাবু বাড়ির বারান্দায় বসে কাচের গ্লাসে লাল চা খাচ্ছেন। গত লোকসভা নির্বাচনে এই বাড়িতে একান্তে মিটিং করে গিয়েছিলেন অর্জুন। সেখানে কী কথা
হয়েছিল তা নিয়ে মুখ খোলেননি কেউই। এ বার চায়ে চুমুক দিয়ে তড়িৎবাবু বললেন, ‘‘যে সব বাম ভোট রামে গিয়েছিল, তার বেশির ভাগই ফিরবে।’’

এই ভোট ফেরার অপেক্ষাতেই রয়েছেন মোর্চার একঝাঁক
তরুণ, নবীন প্রার্থী। তবে সমর্থকদের মধ্যে ‘আগে রাম, পরে বাম’-পন্থীরা কি কমজোরি হয়েছেন? বিজেপি নেতারা বলছেন, লোকসভার মতো এ বারেও বাম-জমিনের ফসল তুলবেন তাঁরাই। তৃণমূলের পাল্টা আশা, ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের কথায় কাজ হবে।
গায়ের ‘রাম-গন্ধ’ এ বার মুছবেন অনেক বাম সমর্থক। যার ‘প্রসাদ’ পাবে ঘাসফুল।

জটিল পাটিগণিতে সবার শেষ পর্যন্ত ভরসা ‘রাম-প্রসাদ’ই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement