প্রতীকী ছবি।
ভোট-প্রচারে টুইটারে কোনও পক্ষের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে সরকারি প্রকল্প। কোনও পক্ষের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে জনগণের আর্থিক অবস্থা। কেউ আবার প্রচারে ধর্মীয় সম্ভাষণ, আচার আচরণের কথা অন্যদের চেয়ে বেশি তুলে ধরেছে। তবে টুইটারের ভোট প্রচারের বয়ানে প্রশংসা বা সমালোচনা, সব কিছুর মধ্যমণি হয়ে থেকেছেন বাংলার রাজনীতির মুখ্য চরিত্র, তৃণমূলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। বাংলার ভোট-যুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক আগেই টুইটারে ভোট-প্রচারের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করে এমনই দেখিয়েছেন ভারতের মাইক্রোসফট রিসার্চ ল্যাবের গবেষক জয়জিৎ পাল ও রিসার্চ ইন্টার্ন রায়না গ্রোভার।
মঙ্গলবারই নিজের ওয়েবসাইটে ‘টুইটার এবং বাংলার বিধানসভা নির্বাচন ২০২১’ শীর্ষক এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান, অ্যান আরবরের শিক্ষক জয়জিৎ। বর্তমানে ভারতের মাইক্রোসফট রিসার্চ ল্যাবে গবেষণা করছেন জয়জিৎ। তিনি এবং রায়না গত লোকসভা ভোটের পরে, ২০১৯-এর অগস্ট থেকেই টুইটারে তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেসের গতিবিধি নজরে রেখে বিশ্লেষণ করে এই গবেষণা করেছেন।
জয়জিৎ ও রায়নার মতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইটারে সর্বাধিক আলোচিত রাজনৈতিক চরিত্র ছিলেন এই ভোটে। সে কারণেই এ বারের ভোটে তাঁর মূল বিরোধী, বিজেপিও তাঁকে আক্রমণ করার সময় অত্যন্ত সতর্ক ছিল। মমতার প্রবল জনপ্রিয়তার কারণেই বিজেপি এমনটা করেছে বলে মত গবেষকদের। গবেষকদের মতে, দেশের রাজনীতির বিষয়ের ক্ষেত্রে মমতাকে বিজেপি শিবির সরাসরি আক্রমণ করলেও রাজ্যের ক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট সাবধানী ছিল। কারণ, জনমানসে তৃণমূল কর্মীদের একাংশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকলেও নেত্রী হিসেবে মমতার প্রবল জনপ্রিয়তা রয়েছে।
টুইটারে বিজেপির প্রচার থেকেও তা বোঝা গিয়েছে বলে গবেষণাপত্রে দাবি করেছেন জয়জিৎ ও রায়না। তাঁদের মতে, বিজেপির আক্রমণের সিংহভাগই ছিল দল হিসেবে তৃণমূল ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো, তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। #আরনয়অন্যায়, #পিসিহারছেবাংলাজিতছে ইত্যাদি হ্যাশট্যাগের মধ্যে দিয়ে এ ভাবেই সরাসরি মমতাকে আক্রমণ না করে বিজেপি তৃণমূলকে আক্রমণ করেছে বলে গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে।
সমাজমাধ্যম বিশ্লেষক অনেকেরই মতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেত্রীর প্রচারে এই ভূমিকায় থাকা অস্বাভাবিক নয়। কারণ, ভোট প্রচার আবর্তিত হয় মুখ্য, জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ঘিরেই। দেশের ভোটের ক্ষেত্রে তা বিজেপির তরফে নরেন্দ্র মোদীকে তুলে ধরা ও বিরোধীদের মোদীকেই সমালোচনা করা থেকে দেখা গিয়েছে। কংগ্রেসকে আক্রমণও করা হয়েছে রাহুল গাঁধীকে ঘিরেই। সেই ধারা অনুসরণ করেই তৃণমূলের প্রচারে বরাবরই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে কখনও তিনি দিদি হিসেবে অভিভাবক, কখনও বাংলার ঘরের মেয়ে। গত বছর লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরানোর সময় তৃণমূলের তরফে প্রচার করা হয়েছিল #চিন্তানেইদিদিআছে হ্যাশট্যাগ দিয়ে। পরের দিকে #বাংলারগর্বমমতা, #বাংলানিজেরমেয়েকেইচায় বলে প্রচার হয়েছে।
গবেষণাপত্রে দেখানো হয়েছে, তৃণমূলের প্রচারে একটা বড় অংশ জুড়ে থেকেছে সরকারি প্রকল্পের কথা। জানুয়ারি ২০২০ থেকে এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত নানা দলের নেতারা কী কী বিষয়ে টুইট করেছেন তার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা দেখিয়েছেন তৃণমূল নেতারা অন্য দলের কথা বলার চেয়ে নিজেদের সরকারের নানা প্রকল্পের বিষয়ে বেশি টুইট করেছেন। কংগ্রেস ও সিপিএমের টুইটে বেশি করে এসেছে দারিদ্রের প্রসঙ্গ। সিপিএমের প্রচারে ‘ছাত্র’, ‘শ্রমিক’, ‘প্রতিবাদ’ এই ধরনের শব্দ বেশি ব্যবহার হয়েছে। ধর্মীয় প্রসঙ্গ, দেবদেবীর নাম, ধর্মীয় উৎসবের শুভেচ্ছা ইত্যাদি অন্যদের তুলনায় বেশি ব্যবহার করেছে বিজেপি।
এ বারের ভোট-প্রচারে বারবার এসেছে বহিরাগত প্রসঙ্গ। টুইট বিশ্লেষণে সেই প্রসঙ্গেরও সূত্র মিলেছে। গবেষণাপত্রে দাবি, বিজেপির তরফে মূলত নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, জে পি নড্ডা, কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের মতো জাতীয় স্তরের নেতাদের বক্তব্যই বেশি তুলে ধরা হয়েছে টুইটারে। এ রাজ্যের নেতাদের মধ্যে দিলীপ ঘোষ ও বাবুল সুপ্রিয়— এই দু’জন উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব পেয়েছেন। তৃণমূলের তরফে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েই বিজেপিকে বাংলার বাইরের নেতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত দল বলে আক্রমণ করা হয়েছে।