শুভেন্দু অধিকারী।
সাদা রঙের মারুতি আর্টিগা-র সামনের আসন থেকে নেমেই দৌড়ে ঢুকে গেলেন পাশের সিংহবাহিনী মন্দিরে। তার মধ্যেই পাড়ার মহিলারা শুভেন্দু অধিকারীকে গাঁদাফুলের পাপড়ি ছুড়ে প্রায় গেরুয়া করে দিয়েছেন। মন্দিরে ঢুকেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জ্বালিয়ে ফেললেন ধূপকাঠি। প্রণাম সেরে, ঘণ্টা বাজিয়ে পাঞ্জাবির ডান পকেট থেকে ২০০ টাকার একটা নোট বার করে রেখে দিলেন প্রণামি-থালায়। তার পর প্রায় দৌড়ে উঠে গেলেন ৫০ মিটার দূরের ছোট্ট মঞ্চে। আর এই গোটা পর্বটাই সারলেন খুব বেশি হলে তিন মিনিটের মধ্যে।
দ্রুতিই যেন তাঁর দ্যূতি। চলাফেরা, ভাষণ, কথাবার্তা, সংবাদমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া— সবেতেই অত্যন্ত দ্রুততা। সারা দিনে হাজারো কর্মসূচি। তবে কোথাও কোনও ক্লান্তি নেই। ঘনিষ্ঠরা বলছেন ‘দাদার এনার্জির শেষ নেই’। একটা গাম্ভীর্য সব সময় মুখে লেগে রয়েছে। কঠিন মুখেই সবটা সামলাচ্ছেন। গলার স্বর বেশির সময়ই বেঁধে রেখেছেন উঁচুতে। সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময় কানের কাছে মুখ এনে বলছেন। ও পাশের লোকটিও তা শুনতে পাচ্ছেন না। এতটাই ভারসাম্য।
সাদা পাঞ্জাবি, সাদা ঢোলা পাজামা, পায়ে কালো রঙের স্যান্ডেল। এটাই শুভেন্দুর চিরকালীন ‘ড্রেস কোড’। বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার পর কপালে টানা গেরুয়া তিলক আর গলায় পদ্মছাপের উত্তরীয় যোগ হয়েছে। ওই যে মঞ্চে উঠলেন, তার পর একটানা বলে গেলেন প্রায় ৪৫ মিনিট। পাঁচটা বুথ মিলিয়ে এক একটা পথসভা। সামনের দর্শক-শ্রোতার বয়স মূলত ২০ থেকে ৪০। এর উপরেও আছে। তবে উল্লেখযোগ্য নয়। মঞ্চ থেকে শুভেন্দুর কঠিন চোখ কিন্তু গোটা সময়টা ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রত্যেকের চোখে চোখে।
সেই অনুযায়ী শরীরও ঘোরাচ্ছেন। মাইক্রোফোনটা মাঝে মাঝেই হাতবদল করছে। কিন্তু কখনও গলার স্বর নামছে না। নিজস্ব ঢঙে একটানা বলে চলেছেন। বলছেন বলতে, সেই একই কথার এ পাশ-ও পাশ যদিও। যার বেশির ভাগটাই ‘মাননীয়া’ আর ‘বেগম’কে কটাক্ষ করে। সে সব শুনেই সামনের জনতা উদ্বেলিত। হাততালি থামার জন্য যদিও অপেক্ষা করছেন না শুভেন্দু। কখনও চোখ পাকানো, কখনও সঙ্কুচিত, চোয়াল কখনও আরও কঠিন— তিনি বলে চলেছেন নাটকীয় ভঙ্গিমায়।
ভেটুরিয়ার সভায় শুভেন্দু যখন আমপানের টাকা লুটের অভিযোগ তুলছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে, তখন মঞ্চের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিজেপি কর্মী বলছিলেন, ‘‘যাওয়ার সময় পাশের স্কুলটা দেখে যাবেন। চালাটা সেই যে উড়ে গিয়েছে, আর ঠিকই করেনি।’’ মঞ্চে তখন শুভেন্দু বলছেন, ‘‘আপনাদের গ্রামে এক জন আমপানে মারা গিয়েছিলেন! কে এসেছিল সে দিন?’’ সমবেত উত্তর, ‘‘আপনি।’’ মে মাসে আমপান ঘূর্ণিঝড় যখন হয়, তখন শুভেন্দু তৃণমূলে। সেই তৃণমূলনেত্রী এ বারের নির্বাচনে শুভেন্দুরই প্রধান প্রতিপক্ষ। শেষপর্বের প্রচারে তিনিও রয়েছেন নন্দীগ্রামে। এখানকার উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্নও তুলছেন। গত পাঁচ বছর ধরে নন্দীগ্রামের বিধায়ক শুভেন্দুই ছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর তোলা উন্নয়ন-প্রশ্নের জবাবের রাস্তায় তিনি হাঁটছেন না। বরং ক্ষমতায় এলে বিজেপি সরকার কী কী করবে, ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকারের সুফল কী ভাবে পাবে নন্দীগ্রাম, সে সবই বলছেন।
ভাষণ শেষে জল বা চা— না, সে সবে নেই শুভেন্দু। প্রায় দৌড়ে সোজা উঠে পড়ছেন গাড়ির সামনের আসনে। তাতে বিজেপি প্রার্থীকে কিন্তু বেশ খানিকটা ধাক্কাধাক্কিও করতে হচ্ছে। হ্যাঁ নিজেকেই। সামনে-পিছনে জনা চারেক কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর রক্ষী রয়েছেন। তাঁরাও প্রার্থীকে ফাঁকা এগিয়ে যেতে সাহায্য করছেন। কিন্তু শুভেন্দুর গতির সঙ্গে ওই নিরাপত্তারক্ষীদের তৎপরতাকেও তাল মেলাতে হচ্ছে বেশ কষ্ট করেই।