দ্বিতীয় দফার ভোটের আগে বঙ্গবাসীকে বার্তা বুদ্ধদেবের।
ভোটের আবহে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সবুজ, গেরুয়া, লাল, নীল—সব শিবিরই। দ্বিতীয় দফা ভোটের আগে শেষবেলায় প্রচার চলছে জোর কদমে। তেমনই আবহে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোটকে চাঙ্গা করতে এল রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অডিয়ো বার্তা। নিজের ভবিষ্যৎ নিজেকেই গড়ে নিতে হবে—নন্দীগ্রামে ভোটের আগে মঙ্গলবার বিকেলে বাংলার মানুষের কাছে এমনই বার্তা দিলেন বুদ্ধদেব।
শারীরিক অসুস্থতার জেরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে বহু দিন আগেই দূরত্ব তৈরি হয়েছে তাঁর। সেই অসুস্থ শরীর নিয়ে মঙ্গলবার একটি অডিয়ো বার্তা প্রকাশ করেছেন বুদ্ধদেব। একটানা কথা বলতে যে অসুবিধা হচ্ছে, তা ওই অডিয়োয় বুদ্ধদেবের গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। সেই অবস্থাতেই থেমে থেমে দ্বিতীয় দফার ভোটের আগে সাধারণ মানুষের কাছে প্রবীণ রাজনীতিকের আর্জি, ‘‘পশ্চিম বাংলাকে বিপদ থেকে রক্ষা করুন। গণতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষ সরকার গড়ে পশ্চিমবঙ্গে নতুন ইতিহাস তৈরি করুন।’’ ঘটনাচক্রে, সোমবার নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর ঘটনা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যের পরই বুদ্ধদেবের একটি লিখিত বিবৃতি প্রকাশ করে সিপিএম। তার পর এল এই অডিয়ো বার্তা।
শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকায় ইচ্ছা সত্ত্বেও ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিগেডে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোটের সমাবেশে অনুপস্থিত থাকতে হয়েছিল বুদ্ধদেবকে। সেই ‘অকল্পনীয়’ যন্ত্রণার কথাও এক বার্তাতেই জানিয়েছিলেন তিনি। তার পর নির্বাচন ঘিরে রাজ্যের পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও এত দিন নীরবতা পালন করছিলেন তিনি। কিন্তু সোমবার নন্দীগ্রামে গুলি চলার পিছনে অধিকারী পরিবারের ‘ভূমিকা’ নিয়ে মমতা অভিযোগ করার পরই নিজের রাজনৈতিক জীবনের সেই বিতর্কিত অধ্যায় নিয়ে নীরবতা ভাঙেন তিনি। সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের জমিরক্ষা আন্দোলনের পিছনে ‘কুটিল চিত্রনাট্য’ কাজ করেছিল বলে লিখিত বিবৃতিতে জানান তিনি।
তার পর মঙ্গলবার ফের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের প্রসঙ্গ টেনেই মুখ খুললেন বুদ্ধদেব। বৃহস্পতিবার, দ্বিতীয় দফায় নন্দীগ্রামেই ভোটগ্রহণ, যেখানে মুখোমুখি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর সময়ের ‘ছায়াসঙ্গী’ শুভেন্দু অধিকারী। অডিয়ো বার্তায় বুদ্ধদেবের মুখেও নন্দীগ্রামের কথা উঠে এসেছে। শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে থেমে থেমে তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা সকলেই বুঝতে পারছি এ রাজ্যের রাজনীতিতে এ এক সন্ধিক্ষণ। বিগত বামফ্রন্টের আমলে আমরা স্লোগান তুলেছিলাম, কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ। এবং সেই চিন্তাধারা নিয়েই আমরা এগিয়েছি। কৃষিতে যেমন সাফল্য এসেছিল, তেমনই শিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করেছিল। বামফ্রন্ট অপসারিত হওয়ার পর তৃণমূলের সরকার রাজ্য জুড়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সমস্ত বিচারেই রাজ্যের অর্থনীতিতে নেমে এসেছে বিপর্যয়, হতাশা। কৃষিতে সঙ্কট, কৃষকের সঙ্কট। কৃষিজাত দ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া হয়েছে।’’
সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম অধ্যায়ের পরেই বাংলায় শিল্পায়নের গতি নিয়ে লাগাতার আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকারকে। একই সুর ধরা পড়েছে বুদ্ধদেবের গলাতেও। তিনি বলেন, ‘‘এ রাজ্যে শিল্প, শিল্পায়ন সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। গত ১০ বছরে উল্লেখযোগ্য একটি শিল্পও আসেনি। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে এখন শ্মশানের নীরবতা। শিক্ষায় নৈরাজ্য, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, নাগরিক জীবনের চাহিদাগুলি অবহেলিত। সামাজিক জীবনে গণতন্ত্র আক্রান্ত হচ্ছে। স্বৈরাচারী শাসকদল, তাদের কর্মীবাহিনী এবং সমাজবিরোধীরা একজোট হয়েছে। মহিলাদের নিরাপত্তা ভয়ঙ্কর ভাবে বিঘ্নিত। এই পরিস্থিতি চলতে পারে না। বিশেষত যুব সম্প্রদায় যাঁরা দেশের ভবিষ্যৎ, তাঁরা এখন আশাহীন, উদ্যোগহীন, হতাশায় জড়িয়ে পড়ছেন। রাজ্য ছাড়ছেন অনেক যুবক। দেশের অন্যান্য জায়গায় গিয়ে চাকরির সন্ধানে বাঁচার চেষ্টা করছেন।’’
ব্রিগেডে সংযুক্ত মোর্চার সমাবেশের সাফল্যের পর নীলবাড়ির লড়াইয়ে বামেদের সম্ভাবনা নিয়ে ইতিমধ্যেই নানাবিধ রিপোর্ট উঠে এসেছে। তবে সংযুক্ত মোর্চার সাফল্য নিয়ে এখনও সন্দিহান অনেকেই। তাই তৃণমূলকে যেন তেন প্রকারে সরানোই মূল লক্ষ্য বলে বাম শিবিরের একাংশের মুখেও শোনা গিয়েছে। তবে বুদ্ধদেবের মতে, তৃণমূল-বিজেপি, দুই দলই বাংলার পক্ষে ভয়ঙ্কর। বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ-এর ধর্ম নিরপেক্ষ জোটই বাংলাকে বাঁচাতে পারে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এক দিকে তৃণমূলের এই স্বৈরতান্ত্রিক নৈরাজ্য। অন্য দিকে, বিজেপি-র আগ্রাসন। রাজ্যে যেমন বিপদের পরিবেশ তৈরি করেছে, তেমনই এনে দিয়েছে এক সম্ভাবনা। বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং ধর্ম নিরপেক্ষ একটি দল তারা একটি যৌথ মঞ্চ তৈরি করেছে। এই নির্বাচনে সংগ্রাম করবার জন্য। রাজ্যের যুবসমাজ তারা এই সংগ্রামের সামনের সারিতে রয়েছে। তারা চায় শিল্প, তারা চায় শিক্ষা, তারা চায় সমাজের উন্নত মূল্যবোধ। নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির জয় হলে নতুন সরকার তৈরি হবে। যারা বিপদগ্রস্ত গণতন্ত্রকে রক্ষা করবে। রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, কৃষক, মানুষের জীবন জীবিকার দাবিগুলি সম্পর্কে সতর্ক থেকে কাজ করবে। আমার আবেদন সকলের কাছে, পশ্চিমবাংলাকে বিপদ থেকে রক্ষা করুন। গণতান্ত্রিক ধর্ম নিরপেক্ষ সরকার তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গে নতুন ইতিহাস তৈরি করুন।’’
দ্বিতীয় দফায় ভোট নন্দীগ্রামে। সেখানে মমতা-শুভেন্দুর বিরুদ্ধে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। তার আগে প্রচারের শেষলগ্নে বুদ্ধের এই বার্তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। এর আগে, ২০১৬-র এপ্রিলে বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে কলকাতার পার্ক সার্কাসে বাম-কংগ্রেসের যোথ সভায় রাহুল গাঁধী এবং অধীররঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে একই মঞ্চে মাল্যভূষিত বুদ্ধদেবকে দেখা গিয়েছিল। সেখানে বক্তৃতাও করেছিলেন তিনি। সেই শেষ বার তাঁর গলা শোনা গিয়েছিল। তার পর এই প্রথম অডিয়ো বার্তা এল তাঁর কাছ থেকে।