সীতারামপুর জেটিঘাটে এ ভাবেই ওঠানামা করেন যাত্রীরা। নিজস্ব চিত্র।
ঘিরে রেখেছে নদী-সমুদ্র। যা এক দিকে জীবন-জীবিকার রসদ জোগায়। আবার একই সঙ্গে বিপর্যয়ের ইঙ্গিত বয়ে আনে পাথরপ্রতিমার মানুষের কাছে। বিপর্যয় ঘটেও বার বার। বুলবুল, আমপানের জোড়া ধাক্কা এখনও পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেননি পাথরপ্রতিমার মানুষ। সুরক্ষার জন্য তাঁরা চান পাকা বাঁধ। কিন্তু বছরের পর বছর কাটে, এক ভোট মিটে এসে পড়ে অন্য ভোট। নানা প্রতিশ্রুতির বান ডাকে। কিন্তু কাজের কাজ যে কী হয়, তার হিসেব আর চোখে দেখতে পান না দ্বীপভূমির মানুষ।
পাথরপ্রতিমা বিধানসভা কেন্দ্রে নদী-সমুদ্র ঘেরা ১৫টি দ্বীপ রয়েছে। আমপানে জলোচ্ছাসে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার নদী ও সমুদ্র বাঁধ তছনছ হয়েছে। সব ভাঙন এখনও সারিয়ে তোলা যায়নি। আমপানের পরে তালিতাপ্পি দিয়ে কোনও মতে নোনা জল আটকানো গেলেও কংক্রিটের বাঁধ তৈরি না হওয়ায় পূর্ণিমা বা অমাবস্যার কটাল হলেই বাসিন্দাদের দুশ্চিন্তায় পড়েন। পাকা বাঁধ কেন এখনও সর্বত্র হল না, তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় শাসক দলের নেতাদের। আমপানে ক্ষতিপূরণ দুর্নীতি নিয়েও অভিযোগ ভুরি ভুরি। ২০০৯ সালে আয়লায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পাথরপ্রতিমা। সে সময়ে বাঁধ মেরামতির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ টাকায় কাজ করতে না পেরে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ফেরত চলে যায়। সে সব নিয়েও শাসক দলকে গঞ্জনা শুনতে হয়।
নদীনালা ঘেরা দ্বীপে রয়েছে ৬০-৬৫টি জেটিঘাট। দীর্ঘ দিন সংস্কার হয়নি। আমপানের জেরে বেশ কিছু ঘাট ভেঙেও পড়েছে। কিছু ঘাটের সামনে চর পড়ে যাওয়ায় নদীতে ভাটা পড়লে হাঁটুসমান কাদা মাড়িয়ে নামাওঠা করতে হয়। অধিকাংশ ঘাটে পানীয় জল, শৌচালয় বা যাত্রী ছাউনির ব্যবস্থা নেই। যাত্রীদের খোলা আকাশের নীচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
অচিন্ত্যনগর, ব্রজবল্লভপুর. জি প্লট-সহ বিভিন্ন পঞ্চায়েতে বহু গ্রামীণ রাস্তাঘাট মাটির থেকে গিয়েছে। বর্ষার সময়ে কাদা মাড়িয়ে যাতায়াত করতে হয়। আনাজ, পান ও মাছ উৎপাদন হয় এখানে। কিসান মান্ডি তৈরি হলেও হিমঘর না থাকায় চাষিরা সমস্যায় পড়েন।
পাথরপ্রতিমার বাসিন্দাদের কাকদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবার ও কলকাতায় যাতায়াত করতে লঞ্চ বা ভুটভুটিতে করে রামগঙ্গা বাস মোড় আসতে হয়। সেখান থেকে বাস ধরতে হয়। আবার পাথরপ্রতিমা বাস স্ট্যান্ড থেকে সরকারি বা বেসরকারি বাসে পৌঁছনো যায়। কিন্ত রামগঙ্গা বাস স্ট্যান্ডে বেলা ২টোর পরে আর কোনও সরকারি গাড়ি থাকে না। ছোট গাড়িতে করে বেশি ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে পৌছতে হয়।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে জি প্লটের ইন্দ্রপুর, ব্রজবল্লভপুর, গদামথুরায়। একটি গ্রামীণ হাসপাতাল রয়েছে। স্বাস্থ্যেকেন্দ্রগুলিতে পরিকাঠামো অভাবে বহু রোগীকেই কাকদ্বীপ মহকুমা বা ডায়মন্ড হারবার জেলা হাসপাতালে রেফার করা হয়।
২০১১ সালে থেকে পর পর দু’বার তৃণমূলের টিকিটে বিধায়ক হয়েছেন সমীর জানা। তবে লোকসভা ভোটের পর থেকে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত ভাবাচ্ছে শাসক দলকে। ইতিমধ্যে জি প্লটে গিয়ে সভা করে এসেছেন বিজেপির রাজ্যে সভাপতি দিলীপ ঘোষ। মথুরাপুর সাংগঠনিক জেলায় ক’দিন আগে কাকদ্বীপে সভা করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
পাথরপ্রতিমার সিপিএমের এরিয়া কমিটির সম্পাদক সত্যরঞ্জন দাসের অভিযোগ, ‘‘আমপানে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তেরা টাকা পাননি। শাসকদল স্বজনপোষণ করেছে। বহু জেটিঘাট মেরামত না করায় বিপজ্জনক ভাবে নামাওঠা করতে হয়। পাথরপ্রতিমা, রামগঙ্গা ও সীতারামপুর— এই তিনটি জায়গায় ভাসমান জেটিঘাট করার জন্য উদ্বোধন হলেও এখনও কাজ শুরু হয়নি। বিদ্যুৎ এখনও সর্বত্র পৌঁছয়নি।’’ পাথরপ্রতিমার বাসিন্দা, বিজেপির মথুরাপুর সাংগঠনিক জেলার সহ সভাপতি সুর্নিমল দাস বলেন, ‘‘আমপানে ভেঙে যাওয়া বাঁধগুলি এখনও পাকাপাকি ভাবে তৈরি হল না। ফের বর্ষায় এলাকা প্লাবিত হবে। বহু গ্রামীণ রাস্তা মাটির রয়ে গিয়েছে। শাসক দলের মদতে জঙ্গল কেটে মাছের ভেড়ি তৈরি হওয়ায় বাঁধের দফারফা। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবাও বেহাল।’’ স্টেডিয়াম তৈরি হল না বলে আক্ষেপ তাঁর। কৃষি ও মৎস্যজীবী-প্রধান এলাকা হলেও হিমঘরের সমস্যা রয়ে গিয়েছে বলে জানালেন তিনি।
সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বিদায়ী বিধায়ক বলেন, ‘‘৩টে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল। আবার নতুন করে অচিন্ত্যনগরে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্বোধন হল। প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়মিত চিকিৎসক থাকেন।’’ নদীবাঁধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমপানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে মানুষের পাশে দাঁড়াতে ১০-১৫ দিনের মধ্যে সমস্ত বাঁধ অস্থায়ী ভাবে তৈরি করে জল আটকে দিয়েছিলাম। বেশ কিছু বাঁধ পাকাপাকি ভাবে তৈরি করা হচ্ছে। কিছু বাঁধের কাজ করার জন্য বিভাগীয় দফতরে জানানো হয়েছে।’’ স্টেডিয়াম ও হিমঘর করার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানালেন তিনি। কিছু জেটিঘাট নতুন করে তৈরি ও সংস্কার করা হচ্ছে বলে দাবি সমীরের। প্রায় সমস্ত গ্রামীণ রাস্তাঘাট ইট বা কংক্রিটের করা হয়েছে। বিদ্যুৎ পরিষেবা সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান।