অধীর চৌধুরী হয়তো হাসছেন।
হাসতেই পারেন। তাঁর তো এলও না কিছু, গেলও না কিছু। কিন্তু তাঁর সঙ্গে জোট করতে গিয়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বামেদের আমও গেল, ছালাও গেল।
কংগ্রেস গত বারে ১৪ আসন পেয়েছিল, এ বারেও তা-ই। বামেরা গত বার পেয়েছিল ৭টি আসন, এ বারে নেমে এসেছে চারে।
বা, এর পরেও অধীর চৌধুরী হয়তো ঠিক করে হাসতে পারছেন না। একে তো উপমুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। তার উপরে, গত বছর থেকে শুভেন্দু অধিকারী যে এই জেলায় ঘাঁটি গেড়েছিলেন, হাতেনাতে তার ফল ফলেছে। এক আসন থেকে চারটিতে লাফিয়ে উঠেছে ত়ৃণমূল।
এক দিকে জোট, অন্য দিকে ফ্রন্ট— একই সঙ্গে দুই নৌকায় পা রাখতে গিয়ে মুর্শিদাবাদে নাক কাটা গিয়েছে সিপিএমের। কোনও কেন্দ্রে জোটধর্ম পালন, আবার পাশের কেন্দ্রে ফ্রন্টধর্ম পালনের দু’মুখো নীতি নেওয়ার কারণেই তাদের ভরাডুবি হয়েছে বলে ওয়াকিবহাল মহলের অনেকের অভিমত।
মুর্শিদাবাদ জেলায় একটি আসন থেকে তৃণমূলকে ৪টিতে পৌঁছে দেওয়ার জোটের প্রধান কারিগর তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও সিপিএমকেই দায়ী করছেন। বলছেন, ‘‘আমরা হরিহরপাড়া নিয়ে সাগরদিঘি সিপিএমকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। ওই প্রস্তাব গ্রহণ করলে দু’টি আসনের একটিও তৃণমূলের দখলে যেত না। জোটই পেত দু’টি। প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় ত্রিমুখী লড়াইয়ে তৃণমূল সুবিধা পেল।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘জঙ্গিপুরে ২০১১ সালে জিতে কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা হয়েছিলেন মহম্মদ সোহরাব। বলা নেই কওয়া নেই, দুম করে সিপিএম ওই কেন্দ্রে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিল। ফলে এখানেও ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ নিল তৃণমূল। উল্টো দিকে, ডোমকলে কংগ্রেস প্রার্থী দিয়েছিল বলেই সিপিএম নেতা আনিসুর রহমান জিতেছেন। নইলে ওখানেও তৃণমূল জিতত। ভোটের পরিসংখ্যানই তার অকাট্য প্রমাণ।’’
পরিষদীয় দলনেতার আসনটি খোয়াতে হলেও আরএসপি-র দখলে থাকা ভারতপুর আসনটি ছিনিয়ে নিয়ে তৃণমূল ঝড়ের দাপটের দিনেও আসন সংখ্যার নিরিখে জেলা কংগ্রেস নিজের ঘর অটুটই রেখেছে। ২০১১ সালের ভোটে এ জেলায় কংগ্রেসের ১৪ জন বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ বারও এ জেলায় কংগ্রেসের বিধাযক সংখ্যা ১৪। তাতে অবশ্য কংগ্রেসের আত্মতৃপ্তি পাওয়ার সুযোগ তেমন নেই। কারণ, শতাংশের নিরিখে কংগ্রেসের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে তৃণমূল। নিজের ছেলে সৌমিক হোসেনকে ডোমকল থেকে জেতাতে না পারলেও মাত্র বছর দেড়েক জেলা তৃণমূল সভাপতির দায়িত্ব সামলে দু’টি কৃতিত্বের দাবিদার হয়েছেন মান্নান হোসেন। তাঁর কথায়, ‘‘এক থেকে এ বার বিধায়ক সংখ্যা চার হয়েছে। আর ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূলের পাওয়া ১৯ শতাংশ ভোট বেড়ে এ বার হয়েছে ৩১ শতাংশ। তার সুফল মিলবে আগামী দিনে।’’
মান্নান হোসেন জেলা সভাপতি হওয়ার পরেই দলের মুর্শিদাবাদ জেলা পর্যবেক্ষক হন তৃণমূলের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। মান্নান-শুভেন্দুর যুগলবন্দির সাফল্য সত্ত্বেও পায়ের তলায় কাঁটার মতো বিঁধছেন দল থেকে বহিস্কৃত প্রাক্তন মন্ত্রী হুমায়ুন কবীর। রেজিনগরের নির্দল প্রার্থী হুমায়ুন তৃণমূল প্রার্থী সিদ্দিকা বেগমকে তৃতীয় স্থানে ঠেলে দিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে হাড্ডাহড্ডি লড়াই দিয়ে মাত্র ৫৫৬০ ভোটে পরাজিত হয়েছেন। নির্দল হুমায়ুন পেয়েছেন ৭৪২১০। সে ক্ষেত্রে জোড়াফুলের সিদ্দিকা পেয়েছেন মাত্র ১৪৬৩১। মান্নান অবশ্য হুমায়ুনকে ওই কৃতিত্ব দিতে নারাজ। মান্নান বলেন, ‘‘নির্দল হয়ে দাঁড়ালেও হুমায়ুনকে মানুষ তৃণমূলই ভাবে। তাই ভোটের ফল ওই রকম।’’ তা শুনেই হুমায়ুনের তেরিয়া জবাব, ‘‘মান্নান তো একটা গদ্দার। তিনি তো পুলিশ-প্রশাসন সব সঙ্গে নিয়েও নিজের ছেলেকে জেতাতে পারেন না। তাঁর কথার কোনও দাম নেই আমার কাছে। মানুষের সঙ্গে থাকি। মানুষও আমার সঙ্গে আছেন।’’
সিপিএমকে একই রকম ‘গদ্দার’ বলছে শরিদ দল আরএসপি-ও। এ জেলায় কংগ্রেসের জেতা ৪টি আসন- সহ মোট ৫টি আসনে ফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে আরএসপি-র ৫ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছিলেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। ওই ৫টির মধ্যে ভরতপুরে বরাবর আরএসপি জিতেছে। কিন্তু এ বার এ জেলায় আরএসপির ঝুলি শূন্য। সব ক’টিই দখল করেছে কংগ্রেস। আরএসপি-র জেলা সম্পাদক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিমানবাবু মুখে শরিক দলের পাশে থাকার কথা বললেও এ জেলায় শরিক দল আরএসপি এবং ফরওয়ার্ড ব্লককে ভোট দেয়নি সিপিএম। এই দ্বিচারিতার জন্য তাদের ভবিষ্যতে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।’’
অধীর চৌধুরী ও বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জোড়া আক্রমণ মুখ বুজে সইছেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘এখনই এসব নিয়ে কিছু বলব না। আগে আমরা বিশ্লেষণ করি, বুঝে নিই। তার পরে বলব।’’
সত্যিই তো, এক পায়ে জোটধর্ম ও অন্য পায়ে ফ্রন্টধর্ম আঁকড়ে থাকলে চটজলদি কিছুই বলা যায় না। ফলটা কেবল দেখে যেতে হয়!