গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্র রাজ্যের সব চেয়ে কম আলোচিত লোকসভা আসনগুলির মধ্যে অন্যতম। তবে ঝড়ঝঞ্ঝা আছড়ে পড়লে শোনা যায় এই কেন্দ্রের অন্তর্গত বিধানসভা আসনের নামগুলো। পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ, সাগর, কুলপি সারা বছর ভয়ে ভয়ে থাকে। এই বুঝি এল ঘূর্ণিঝড়! নদী নদীতে না থেকে উঠোন ভাসিয়ে ঘরে চলে এল বুঝি! ঝড় ছাড়াও মথুরাপুর নজরে পড়ে মকর সংক্রান্তিতে। গঙ্গাসাগরে পুণ্যার্থীর ঢল নামে। তবে সে তীর্থও এতটাই কষ্টের যে ‘সব তীর্থ বার বার, গঙ্গাসাগর এক বার’ প্রবাদ মুখে মুখে ফেরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।
মথুরাপুর লোকসভা আসনের অধিকাংশ এলাকাই জল-জঙ্গলে ঘেরা। সাগর আর পাথরপ্রতিমা বিধানসভা এলাকার বেশিরভাগ এলাকাই নদীনালা-বেষ্টিত। একটা ঝড়ের ক্ষতি সামলে উঠতে না উঠতেই আর একটা এসে যায়। বেশিরভাগই গ্রামীণ ভোটার। শহুরে ভোটার মেরেকেটে ৭ শতাংশ। এমন এক আসনে রাজনৈতিক পালাবদল খুব একটা হয়নি। ১৯৬২ এবং ১৯৮৪ সালে ছাড়া কংগ্রেস জেতেনি কখনও। সিপিএম এবং সিপিএমই ছিল মথুরাপুরে। সবচেয়ে বেশি জিতেছেন রাধিকারঞ্জন প্রামাণিক। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৯ টানা পাঁচ বার। কিন্তু শেষ বার সাংসদ থাকতে থাকতেই দলবদল করেছিলেন তিনি। তবে তার কারণ ছিল। ২০০৩ সালের মে মাসে ‘দুর্নীতি এবং দলবিরোধী কার্যকলাপ’-এর অভিযোগে তাঁকে বহিষ্কার করে সিপিএম। যদিও রাধিকারঞ্জনের অভিযোগ, সাংসদ উন্নয়ন তহবিলের টাকা পার্টির কাজে লাগাতে চেয়েছিল দল। তাতে বাধা দেওয়াতেই দল তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল।
কিন্তু রাধিকারঞ্জন মথুরাপুরেই থেকে যেতে চেয়েছিলেন। বহিষ্কারের পরের বছর ২০০৪ সালে তৃণমূলে যোগ দিয়ে ঘাসফুলের টিকিটে মথুরাপুর থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে জিততে পারেননি। হেরে যান বামপ্রার্থী বাসুদেব বর্মণের কাছে। তার পরে আর টিকিট পাননি। সাংসদ হওয়ার আগে দু’দফায় পর পর তিন বার করে মোট ছ’বার মগরাহাট পূর্ব কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন রাধিকারঞ্জন। ২০২০ সালে প্রয়াত রাধিকারঞ্জন অবশ্য শেষ দিকে রাজনীতি, সিপিএম, তৃণমূল থেকে অনেক দূরে একাই ছিলেন। সঙ্গী ছিল বার্ধক্যজনিত নানা শারীরিক সমস্যা।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তবে মথুরাপুরে যে নেতার কথা না বললেই নয়, তিনি কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। এই লোকসভা এলাকায় তৃণমূলের সবচেয়ে বড় নেতা ছিলেন সত্যরঞ্জন বাপুলি। তাঁর ‘আধিপত্য’ শেষ করতে ২০০১ সালে কলকাতা থেকে কান্তিকে নিয়ে যাওয়া হয় মথুরাপুর বিধানসভায়। সাত বারের বিধায়ক বাপুলিকে হারিয়ে মথুরাপুরে লাল ঝান্ডা উড়িয়ে দেন কান্তি। বিধায়ক হওয়ার পরেই তাঁকে সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী করেছিল সিপিএম। পরে পেয়েছিলেন ক্রীড়া দফতরের দায়িত্বও। কান্তি ওই এলাকা থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই মথুরাপুর লোকসভা দেখভালের দায়িত্বও তাঁকেই দিয়ে দেন সিপিএম নেতৃত্ব। ২০০৪ সালে যখন রাধিকারঞ্জনের বদলে অধ্যাপক বাসুদেবকে প্রার্থী করে সিপিএম, তখনও তাঁকে জেতানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কান্তিকেই। সে বার দলের দেওয়া দায়িত্ব পালনে সফল হলেও ২০০৯ সাল থেকেই ভাঙতে শুরু করে কান্তির অন্দরমহল। ২০১১ সালে অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়ের কাছে নিজেও হেরে যান তিনি। তার পর থেকেই আর মথুরাপুর লোকসভার রাজনীতিতে ‘প্রাসঙ্গিক’ নন কান্তি।
মথুরাপুরে ২০০৯ সালে সিপিএম প্রার্থী করেছিল অনিমেষ নস্করকে। কিন্তু তিনি দীর্ঘ দিনের বামদুর্গ রক্ষা করতে পারেননি। সে বারই প্রথম রাজ্যের প্রাক্তন পুলিশকর্তা চৌধুরী মোহন জাটুয়াকে মথুরাপুরে প্রার্থী করেন তৃণমূলনেত্রী। ২০০৮ সালে তৃণমূল প্রথম বার দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ দখল করে। সহকারী সভাধিপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় জাটুয়াকে। লোকসভা ভোটে ‘চমক’ দিয়ে তাঁকেই মথুরাপুরেও প্রার্থী করে তৃণমূল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্ন সফল করেছিলেন জাটুয়া। প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার ভোটে জেতেন তিনি। তার আগে ২০০১ সালের বিধানসভা ভোটে জাটুয়া মন্দিরবাজারের বিধায়ক হয়েছিলেন। মথুরাপুর লোকসভায় পর পর তিন বার জিতেছেন তিনি। প্রতি বারই বেড়েছে ব্যবধান। শেষ বার ২০১৯ সালে দু’লক্ষের বেশি। তবে গত পাঁচ বছরের তাঁকে এলাকায় বিশেষ দেখা যেত না বলেই অভিযোগ উঠেছিল। কারণ, বার্ধক্যজনিত সমস্যা নিয়ে তিনি বেশিরভাগ সময়েই থাকতেন সল্টলেকের বাড়িতে। তাই এ বারের ভোটে তাঁকে প্রার্থী না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তৃণমূল।
এ বার রাজ্যের শাসকদলের নতুন প্রার্থী বাপি হালদার। অনেকে বলছেন, দলের অন্দরে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্বে ‘সুযোগ’ পেয়ে গিয়েছেন বাপি। পঞ্চায়েত রাজনীতি থেকে উঠে আসা যুবনেতা বাপি মৎস্যজীবী পরিবারের সন্তান। ৩৮ বছরের বাপি গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদ আসনে জিতেছেন। এখন তিনি দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের খাদ্য সরবরাহ দফতরের কর্মাধ্যক্ষ। আবার জেলা যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতিও। তবে বাপির জন্য ‘কাঁটা’ও রয়েছে এই ভোটে। এই লোকসভা এলাকায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এতটাই যে, ভোটের আগে-আগে ক্যামাক স্ট্রিটের দফতরে এলাকার সব বিধায়ককে ডেকে বৈঠক করেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল সূত্রের দাবি, সেই বৈঠকে সমন্বয়ের কড়া বার্তা দিয়েছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। এ বারের লোকসভা ভোটের টিকিট বণ্টনে বাপি ‘অভিষেকের প্রার্থী’ বলেই তৃণমূলের অন্দরে আলোচনা।
বাপির স্ত্রী শিলি হালদার কৃষ্ণচন্দ্রপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান। পঞ্চায়েত এলাকায় একই রাস্তার কাজ তিন বার দেখিয়ে টাকা তোলার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। রাস্তার কাজ না করেও সেই কাজের টাকা তুলে নিয়েছেন বলে বিরোধীদের অভিযোগ। মথুরাপুর এক নম্বর ব্লকের বিডিও, ডায়মন্ড হারবারের মহকুমাশাসক, দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসকের পাশাপাশি মথুরাপুর থানা এবং সুন্দরবন পুলিশ জেলার এসপির কাছে অভিযোগ জানান বিজেপির পঞ্চায়েত প্রধান অনুপ মিস্ত্রি। সুরাহা না মেলায় কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। সেই মামলায় মথুরাপুরের ওসি-কে শোকজ করে কোর্ট। কোর্টের নির্দেশের পরে তৃণমূল প্রার্থী বাপির বিরুদ্ধেও মামলা করে পুলিশ। কিন্তু এ সবের প্রভাব কি ভোটে পড়বে? অন্তত চেষ্টায় খামতি রাখছে না বিজেপি।
প্রসঙ্গত, জাটুয়ার প্রথম দুই জয়ে প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল সিপিএম। কিন্তু ২০১৯ সালে তৃণমূল যখন ৫১.৮৪ শতাংশ ভোট পায়, তখন বিজেপির ভোট ৩২ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ৩৭.২৯ শতাংশ। সিপিএম নেমে যায় ৬.৫৯ শতাংশে এবং কংগ্রেস ২.৩১ শতাংশে। এমনই অঙ্ক নিয়ে দুই প্রার্থী বিজেপির অশোক পুরকায়েত এবং সিপিএমের শরৎচন্দ্র হালদারের লড়াই।
বিজেপির অশোক ঘোড়ামারা, মৌসুনি দ্বীপ, পাথরপ্রতিমায় ঘুরে ঘুরে নদীবাঁধ সমস্যার কথা, আমপান, ইয়াস বিপর্যয়ের পরে ক্ষতিপূরণে রংবিচারের দৃষ্টান্ত মনে করাচ্ছেন। সিপিএমের শরৎচন্দ্রও বাম আমলে ৩৮টি সেতু তৈরির কথা বলে চলেছেন। আবার তৃণমূলের পাল্টা প্রচারে রাজ্য সরকারের তরফে ইতিমধ্যেই মুড়িগঙ্গার উপরে সেতুনির্মাণের উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে। তবে এ সবের আড়ালে জোরকদমে চলছে ‘মেরুকরণের উস্কানি’। সব পক্ষ মুখে উন্নয়নের কথা বললেও ভিতরে জনবিন্যাসের অঙ্ক কষছে। ভোট ভাগাভাগির ‘ভয়’ থেকে বাদ নেই মথুরাপুরও। ৩০ শতাংশের কাছাকাছি সংখ্যালঘু ভোটে ভাগ বসাতে এই আসনে আছেন আইএসএফের প্রার্থী কলেজশিক্ষক অজয়কুমার দাস। তবে মেরুকরণের ঝাঁজ যতই থাকুক, জল-জঙ্গলের মথুরাপুরে ঘাস উপড়ে পদ্ম ফোটানো সহজ নয়। তবে ঘাসের জমি কিছু আলগা হচ্ছে। যা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে শাসকশিবিরে।