গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মনে মনে এসেছি অনেক আগে, আজ সত্যি এলাম! গত বুধবার কাঁথিতে অমিত শাহকে এমন কিছু বলে থাকতেই পারেন শিশির অধিকারী। কারণ, তিনি তৃণমূলের টিকিটে জয়ী কাঁথির বিদায়ী সাংসদ হলেও অনেক দিন থেকেই এই আসনকে বিজেপি নিজের বলে ভাবে।
কারণ, এই কেন্দ্রের সাংসদ শিশিরের পুত্র বাংলায় পদ্মের ‘অন্যতম মুখ’ শুভেন্দু অধিকারী। কারণ, গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়েও কাঁথির সাংসদ শিশিরকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সঙ্গে একই মঞ্চে দেখা গিয়েছিল। তবে খাতায়কলমে তিনি বিজেপিতে যোগ দেননি। কিন্তু লোকসভায় তৃণমূলের সাংসদ দলের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দিল্লি গিয়েছিলেন ভোট দিতে। একই কাজ করেছিলেন শিশিরের তৃতীয় পুত্র দিব্যেন্দু অধিকারী। তিনিও তৃণমূলেরই সাংসদ ছিলেন। মাসখানেক আগে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।
এ বার পিতা-পুত্রকে অবশ্য টিকিট দেয়নি বিজেপি। তমলুকে প্রার্থী প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের হয়ে প্রচার করছেন ‘বিজেপি কর্মী’ দিব্যেন্দু। তবে কাঁথিতে পিতা শিশিরের পরিবর্তে কনিষ্ঠ পুত্র সৌমেন্দু অধিকারীকে টিকিট দিয়েছে পদ্মশিবির। কাঁথির শান্তিকুঞ্জের অন্দরের খবর যাঁরা রাখেন তাঁদের দাবি, বাড়ির কনিষ্ঠটিকে পিতা শিশিরের মতো ‘মেজদা’ শুভেন্দুও খুব স্নেহ করেন।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তৃণমূলের জন্মের সময়ে কংগ্রেসেই ছিলেন শিশির। অনেক পরে ২০০০ সালে সপুত্র যোগ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে। ২০০৯ থেকে পর পর তিন বার তৃণমূলের টিকিটে কাঁথি থেকে সাংসদ হয়েছেন শিশির। তার আগে অবশ্য তিন বার বিধায়কও হয়েছেন। প্রথম বার ১৯৮২ সালে কাঁথি দক্ষিণ থেকে কংগ্রেসের টিকিটে। আর ২০০১ সালে তৃণমূলের টিকিটে। ২০০৬ সালে মধ্যম পুত্র শুভেন্দুকে ওই আসন ছেড়ে দিয়ে চলে যান এগরা বিধানসভা আসনে। তৃণমূলের বিধায়ক হন। এর পরে মমতা কাঁথি লোকসভায় প্রার্থী করেন শিশিরকে। এ বার বিজেপি ওই আসনের উত্তরাধিকার দিতে চায় অধিকারী পরিবারেরই সৌমেন্দুকে।
শিশির প্রথম বার ২০০৯ সালে ১ লাখ ৩০ হাজারের মতো ভোটে কাঁথিতে হারিয়েছিলেন সিপিএম প্রার্থী প্রশান্ত প্রধানকে। পরের বারে ২০১৪ সালে সিপিএম প্রার্থী করে সেই সময়ের যুব নেতা তাপস সিংহকে। শিশির ব্যবধান এক লাখ বাড়িয়ে নেন। সেই ২ লাখ ৩০ হাজারের ব্যবধান আবার ২০১৯ সালে কমে হয় ১ লাখ ১২ হাজারের মতো। আর প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠা বিজেপি পায় ৪২.১৪ শতাংশ ভোট। চিকিৎসক প্রার্থী দেবাশিস সামন্ত ৩৩.৫৪ শতাংশ ভোট বাড়িয়েছিলেন পদ্মের।
অনেকে মনে করেন তৃণমূল নয়, কাঁথিতে তিন বারই জিতেছিল অধিকারী পরিবার। যাদের হাতে কাঁথি পুরসভাও ছিল বছরের পর বছর। ফলে সৌমেন্দু পিতার উত্তরাধিকার হিসাবে কত আর বিজেপি প্রার্থী হিসাবে কত ভোট পাবেন, সে অঙ্ক কষতে গেলে হাতের পেন্সিল হাতেই রয়ে যাবে। তবে তৃণমূলের একটা যুক্তি রয়েছে। এই আসনেই তৃণমূল এক বার জয় পেয়েছে যখন অধিকারীরা কংগ্রেসে। সেটা ১৯৯৯ সালে। বিজেপির সঙ্গে জোটে থাকা তৃণমূল সিপিএমকে হারিয়ে দিয়েছিল এখানে। প্রার্থী ছিলেন প্রাক্তন আমলা নীতীশ সেনগুপ্ত। পরের বার ২০০৪ সালে অবশ্য নীতীশ সিপিএমের প্রশান্ত প্রধানের কাছে হেরে যান। প্রসঙ্গত, এই আসনে শিশিরও এক বার হেরেছিলেন। যে বার তৃণমূল জেতে, সে বারই কংগ্রেসের টিকিটে লড়ে তিন নম্বরে ছিলেন শান্তিকুঞ্জের গৃহকর্তা। এর পরেই কংগ্রেসের ‘হাত’ ছেড়ে মমতার ঘাসফুলে চলে আসেন শিশির।
কাঁথির ভোট মানেই যে, ‘অধিকারীদের ভোট’, এমন মানে না তৃণমূল। কারণ, অধিকারীরা পদ্মে যাওয়ার পরে ২০২১ সালের ভোটেই এই কেন্দ্রের অন্তর্গত সাত বিধানসভার মধ্যে তিনটিতে জয় পেয়েছে ঘাসফুল। চণ্ডীপুর, পটাশপুর এবং রামনগর। অন্য দিকে, বিজেপির হাতে কাঁথি উত্তর, কাঁথি দক্ষিণ, ভগবানপুর এবং খেজুরি। তৃণমূল এ বার কাঁথি লোকসভায় প্রার্থী করেছে পটাশপুরের বিধায়ক উত্তম বারিককে। যিনি আবার পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতিও। তবে লড়াই সহজ নয় তাঁর। লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের অঙ্ক আলাদা হলেও শেষ নির্বাচনের রেশ থাকে বলে অনেকেই মনে করেন। আর সেই ২০২১ সালের অঙ্ক বলছে, বিজেপি কাঁথিতে ২১ হাজারের মতো ভোটে এগিয়ে।
লড়াই দ্বিমুখীই। ফলে ভোট-চর্চায় উপেক্ষিত জোট প্রার্থী। সিপিএম না কংগ্রেস, এই যুদ্ধ লম্বা চলার পরে হাতের হাতেই যায় কাঁথি। অনেকটা দেরি করে প্রার্থী করা হয় ঊর্বশী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। নির্বাচনী রাজনীতির আঙিনায় একেবারেই নবাগতা আইনজীবী ঊর্বশীর হাতে রয়েছে ২০২৪ সালে সিপিএম-কংগ্রেস মিলিয়ে পাওয়া সাড়ে ৬ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস বা তৃণমূল যত আশাই করুক, এই রাজ্যে বিজেপির অতীতে জেতা সব আসনের থেকে ‘সহজ’ মনে করা হচ্ছে কাঁথিকে। কারণ, ২০১৯ সালে পদ্ম প্রতীকে বিজেপি পেয়েছিল ছ’লাখ ভোট। এর সঙ্গে লাখ খানেক ‘অধিকারী ভোট’ এলেই বড় ব্যবধানে জয় নিশ্চিত বিজেপির।