গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ডায়মন্ড হারবার। তৃণমূলের সেনাপতির আসন। ‘খ্যাতি’ থাকলেও রাজ্য রাজনীতিতে তেমন আলোচনা নেই এই আসন নিয়ে। কারণ, এখানে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ই জিতবেন। ২০১৯ সালেই তাঁর জয়ের ব্যবধান ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার। তখনও তিনি শুধুই সাংসদ। যুবর দায়িত্ব থাকলেও মূল দলে কোনও পদ ছিল না। ২০২১ সালের নীলবাড়ির লড়াই থেকেই দলের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন অভিষেক। বড় সাফল্য পায় দল। অভিষেক দায়িত্ব পান সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের। এটা অনস্বীকার্য যে, দেশের অন্য রাজ্যে লড়াইয়ে নামলেও সে ভাবে ‘সাফল্য’ আসেনি তৃণমূলের। কিন্তু দলের সেনাপতির মুকুট অভিষেকের মাথায় বসে গিয়েছে। ক্যামাক স্ট্রিটে তাঁর অফিস এখন তৃণমূলের অন্যতম ‘ভরকেন্দ্র’। গোটা রাজ্যে সব প্রার্থীর ছবির পাশে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিষেকের ছবি। সারা রাজ্য জানে, তৃণমূল তো বটেই, রাজ্য রাজনীতিতেও মমতার উত্তরসূরি তিনিই।
১০ মার্চ ব্রিগেড সমাবেশ থেকে নাটকীয় ভাবে তৃণমূলের সম্পূর্ণ প্রার্থিতালিকা ঘোষণা করা হয়। ঘোষক অভিষেক। যে প্রার্থিতালিকায় তাঁর পছন্দ গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রের প্রার্থীর নাম বলার আগে তিনি থেমে যান। রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও ইন্দ্রনীল সেন মাইক্রোফোন হাতে তুলে নিয়ে ঘোষণা করেন অভিষেকের নাম। যা নিয়ে কারও মনে কোনও অনিশ্চয়তা ছিল না। তবু ‘জনগর্জন সভা’য় কর্মী-সমর্থকদের বিপুল গর্জন কারও কান এড়ায়নি।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার মূলত গ্রামনির্ভর এই আসনে তৃণমূলের দখলে আসে ২০০৯ সালে। জিতেছিলেন প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র। বার বার কংগ্রেস-তৃণমূল-কংগ্রেস করা, নিজের দল ‘প্রগতিশীল ইন্দিরা কংগ্রেস’ তৈরি করা সোমেন শেষ পর্যন্ত অনুজা মমতার শরণ নিয়েই জীবনে প্রথম বার সাংসদ হন। পাশে ছিলেন এখন রাজনীতি থেকে দূরে থাকা কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়। সিপিএমের শমীক লাহিড়িকে দেড় লাখ ভোটে হারিয়েছিলেন তৃণমূলের সোমেন।
তবে তৃণমূলের দ্বিতীয় স্থানে আসার শুরু ১৯৯৮ সালে। পরবর্তী সময়ে কাকলি ঘোষ দস্তিদার, সর্দার আমজাদ আলি এবং সৌগত রায় এই আসনে দ্বিতীয় হয়েছেন। তার আগে কয়েক বার কংগ্রেস জিতলেও মূলত সিপিএমের হাতেই ছিল ডায়মন্ড হারবার। জ্যোতির্ময় বসু, অমল দত্ত টানা চার বার করে জিতেছেন। দুর্ভ্যেদ্য সেই ‘বাম দুর্গে’ শমীকও চার বার জিতে পঞ্চম বারে হারেন সোমেনের কাছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের ‘অস্বস্তি’ কাটাতে শমীক উদ্যোগী হয়ে ডায়মন্ড হারবারে নিয়ে এসেছিলেন ‘বিশ্ব ফুটবলের রাজপুত্র’ দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনাকে। ফুটবল অ্যাকাডেমি এবং স্টেডিয়াম গড়ার অঙ্গীকার করে মারাদোনার পায়ের ছাপ নেওয়া হয়েছিল। ফুটবল অ্যাকাডেমি কিংবা স্টেডিয়াম তো হয়ইনি, ফুটবলের ঈশ্বরের সেই পদচিহ্ন যে কালের নিয়মে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে, তা-ও ডায়মন্ড হারবারবাসীর অজানা।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সেই আসনে এ বার অভিষেকের হ্যাটট্রিক করার সুযোগ। কেন্দ্রের প্রতি ভালবাসা থেকেই সাংসদ অভিষেক ‘ডায়মন্ড হারবার ফুটবল ক্লাব’ শুরু করেছেন। ডায়মন্ড হারবারবাসীর জন্য পৃথক ‘হেল্পলাইন’ খুলে রেখেছেন সারা বছর। শীতের মরসুমে নিয়ম করে দেশের নামজাদা সঙ্গীতশিল্পীদের জাঁকজমক পূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কখনও সোনু নিগম, কখনও মিকা, কখনও আবার হিমেশ রেশমিয়া এসে অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই গ্রামীণ লোকসভা কেন্দ্রে। এ ছাড়াও পালা করে প্রতি বছর সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে ‘এমপি কাপ’-এর আয়োজন সাংসদ হিসাবে অভিষেকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিই করেছে। কোভিডের সময়ে ডায়মন্ড হারবারবাসীর জন্য পৃথক চিকিৎসার বন্দোবস্ত থেকে সেখানকার গরিব জনতার মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন অভিষেক। রাজ্য রাজনীতিতে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে তাঁর ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’। ফলে অভিষেকের হ্যাটট্রিক কেবল সময়ের অপেক্ষা। যদিও স্থানীয় নেতাদের ‘দাদাগিরি’, পঞ্চায়েত স্তরে ‘দুর্নীতি’র কথা বলে প্রচারে নেমেছে বিরোধীরা।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে অভিষেকের প্রথম বার জয়ের সময়ে ভোট অনেকটাই কমে গিয়েছিল তৃণমূলের। ১৩ শতাংশ ভোট কমেছিল। অভিষেক জিতেছিলেন ৭১ হাজার ভোটে। সে বারেও বিজেপি তিন নম্বরে ছিল। ২০১৯ সালে বিজেপি যখন ১৭ শতাংশের বেশি ভোট বাড়িয়ে দ্বিতীয় হয়, তখন তৃণমূলেরও প্রায় ১৬ শতাংশ ভোট বাড়ে। ডায়মন্ড হারবার বিধানসভা তো বটেই, সঙ্গে এই লোকসভার অন্তর্গত ফলতা, সাতগাছিয়া, বিষ্ণুপুর, মহেশতলা, বজবজ, মেটিয়াবুরুজেও ভোট বাড়ে তৃণমূলের। বড় ব্যবধানে জেতেন অভিষেক।
যে বার ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ হিসাবে অভিষেক হয় তৃণমূল সেনাপতির, সে বার বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন স্থানীয় নেতা অভিজিৎ দাস। যিনি বিজেপিতে ‘ববি’ নামে বেশি পরিচিত। ২০১৯ সালে তাঁর বদলে টিকিট দেওয়া হয়েছিল দক্ষিণ দিনাজপুরের বিজেপি নেতা নীলাঞ্জন রায়কে। এ বারে কোনও ‘অজ্ঞাত’ কারণে ডায়মন্ড হারবারে প্রার্থীর নাম প্রকাশে সবচেয়ে দেরি করেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। পদ্মের প্রথম প্রার্থিতালিকা প্রকাশিত হয়েছিল ২ মার্চ। একে একে সব কেন্দ্র হয়ে গেলেও বাদ থেকে যায় ডায়মন্ড হারবার আসন। শোনা যায়, প্রার্থী হতেই রাজি হচ্ছিলেন না কেউ। বেশ কয়েক জন খ্যাতিমানের কথাও বিবেচনা করেছিল বিজেপি। কিন্তু তাঁরাও পিঠটান দেন। শেষে সেই ববির নামই ঘোষণা করে বিজেপি।
সেই ‘কালক্ষেপ’ নিয়ে বিজেপির মধ্যেই নানা রহস্যময়তার আলোচনা শুরু হয়েছিল। দল কি এই আসনে বড় লড়াই দেওয়ার জন্য কোনও সর্বভারতীয় খ্যাতনামীকে প্রার্থী করতে চায়? না কি ‘কঠিন’ আসন ধরে নিয়ে ‘দুধভাত’ প্রার্থী দিতে চায়? অনেকে বলেন, রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এবং বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মধ্যে ‘মতানৈক্য’ থাকায় প্রার্থী চূড়ান্ত করা যাচ্ছিল না। শেষে সঙ্ঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ ববির নাম ঘোষণায় অনেকেই অবাক হয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গোটা দেশে প্রচারে তাঁর ‘গ্যারান্টি’ শোনাচ্ছেন। ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেকও অন্য ‘গ্যারান্টি’র কথা শোনাচ্ছেন। বলছেন, “ডায়মন্ড হারবারে কী কাজ হয়েছে, সকলে জানেন। গোটা দেশে ডায়মন্ড হারবার মডেল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ বার জেলার চার লোকসভা কেন্দ্রেই ডায়মন্ড হারবার মডেল চালু হবে। এটা আমার গ্যারান্টি।”
বিরোধীরা পাল্টা সরব। বিজেপি-সিপিএম এক সুরে বলছে, ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’ মানে খুন, সন্ত্রাস, পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট লুট। স্বাভাবিক। এই আসনে অভিষেক-বিরোধিতাই বিরোধীদের প্রধান অস্ত্র। সেই অস্ত্রে তৃণমূলের সেনাপতির বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ এবং সিবিআই-ইডির তদন্তের কথাও উঠছে।
এ সবের মধ্যে খানিক ‘অস্বস্তিতে’ সিপিএম। তাদের প্রার্থী ছাত্রনেতা প্রতীক উর রহমান। দলের সর্ব ক্ষণের কর্মী প্রতীক ছাত্র ফেডারেশনের রাজ্য সভাপতি থাকার পাশাপাশি সিপিএম রাজ্য কমিটিরও সদস্য। তবে এখানে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হলেও আলাদা প্রার্থী দিয়েছে নওশাদ সিদ্দিকির আইএসএফ। একটা সময় পর্যন্ত প্রার্থী হিসেবে ভাঙ্গড়ের বিধায়ক নওশাদের কথাই শোনা গিয়েছিল। নওশাদ নিজেও তেমনই চেয়েছিলেন। অন্তত প্রকাশ্যে তা-ই জানিয়েছিলেন। তবে দল তাঁকে সর্বত্র প্রচারে কাজে লাগানোর যুক্তি দেখিয়ে ওই আসনে প্রার্থী করে মজনু লস্করকে। এটাই মজনুর জীবনের প্রথম নির্বাচনী লড়াই। আইনের ছাত্র প্রতীক এবং আইনজীবী মজনুর মধ্যে কে কার ভোট কাটবেন, তা নিয়েও জল্পনা রয়েছে ডায়মন্ড হারবারে। গত নির্বাচনে সিপিএম-কংগ্রেস মিলিয়ে ভোট ছিল ৮ শতাংশের মতো। সেটুকুও ধরে রাখতে না পারলে অভিষেকের জয়ের ব্যবধান বেড়ে যাবে! চিন্তা প্রতীকের। আর মজনু তৃণমূলের ভোট কাটবেন ভেবে রেখে আশায় পদ্মশিবির। কারণ, আইএসএফের ‘ধাত্রীভূমি’ ফুরফুরা শরিফের প্রভাব রয়েছে এই লোকসভা কেন্দ্রের বিস্তীর্ণ এলাকায়।