Lok Sabha Election 2024

ভূমিপুত্র, নিরুদ্দেশ আর লক্ষ্মীর ভান্ডার

দু’বছর আগের উপনির্বাচনের মতো এ বারে ভোট-লড়াই যে খুব সহজ নয়, তা মানছেন সবাই। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে আসানসোল লোকসভার সাতটি আসনের মাত্র দু’টি দখলে ছিল বিজেপির।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

আসানসোল শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২৪ ০৮:২৯
Share:

(বাঁ দিকে) বিজেপি প্রার্থী সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া এবং তৃণমূল প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিন্‌হা (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।

‘খামোশ’!

Advertisement

ফোন করে সাক্ষাৎ চাইতেই, উল্টো দিক থেকে কার্যত চুপ করিয়ে দেওয়া হল। বলা হল, “তিন দিনের আগে কোনও সাক্ষাৎকার নয়।” কোনও ভাবেই কি কয়েক মিনিট কথা বলা যাবে না? আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিন্‌হার এক সহচর জানিয়ে দিলেন, ‘না’। তাঁর দাবি, “নির্বাচন নিয়ে অনেক সাক্ষাৎকার দেওয়া হয়েছে। তাই এখন বিরতি। প্রয়োজনে রোড-শো-এ আসুন, সুযোগ হলে কথা হবে।”

বলিউডের ‘বিহারিবাবু’-র সর্বসময়ের সঙ্গীর এমন কাণ্ড শুনে মুচকি হাসলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিজেপি প্রার্থী সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া। বললেন, “তা হলেই বুঝুন! উনি কী করে আসানসোলের ঘরের লোক হবেন? শেষ দু’বছরে ক’জন সাধারণ মানুষ ওঁকে কাছে পেয়েছেন?” আসানসোল দক্ষিণের বাতাস তখন বেশ তপ্ত। বার্নপুর স্টেশনের কাছাকাছি তৃণমূলের কার্যালয়ের সামনে কর্মী-নেতাদের ভিড়। কিছু ক্ষণ পরেই হুডখোলা জিপে উঠলেন শত্রুঘ্ন। গাড়ি চলতে শুরু করল, ঘিরে থাকা ভিড়ের বলয় মোবাইলে নিজস্বী তোলার ছন্দে এগোতে থাকল সামনের দিকে।

Advertisement

দেখলেন সাংসদ-প্রার্থীকে? রাস্তার ধারে অস্থায়ী দোকানের বৃদ্ধ বললেন, “ভোটের সময় তো, তাই দেখা যাচ্ছে। অন্য সময়ে তেমন দেখতে পাই না।” শুধু তিনিই নন। ২০২২-এর উপনির্বাচনে তিন লক্ষ ভোটে জেতা সাংসদের নির্দিষ্ট কার্যালয় কোথায়, সেটাই জানেন না বলে দাবি কুলটি, রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া থেকে প্রায় সমগ্র আসানসোলের অধিকাংশ সাধারণ মানুষেরই। এমনকি, তীব্র গরমে ভোটপ্রচারেও রাস্তাঘাটে তেমন ভাবে জোড়াফুলের প্রার্থীকে দেখা যাচ্ছে না বলেও মত অনেকেরই। বদলে এসি ঘরেই বেশি হচ্ছে কর্মিসভা। সেই সূত্রেই বিতর্ক উস্কে বিজেপি নেতাদের দাবি, ‘শত্রুঘ্ন তো বহিরাগত। সেখানে আমাদের প্রার্থী ভূমিপুত্র’। তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক ভি শিবদাসন (দাসু) অবশ্য বলছেন, “কে ভূমিপুত্র? সুরেন্দ্র তো ১৯৯৮-এর পরে আসানসোলে পা রাখেননি।” সেখানে গত দু’বছরে বিভিন্ন সভায় শত্রুঘ্ন এসেছেন বলে দাবি তৃণমূল নেতা অশোক রুদ্রের।

তবে দু’বছর আগের উপনির্বাচনের মতো এ বারে ভোট-লড়াই যে খুব সহজ নয়, তা মানছেন সবাই। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে আসানসোল লোকসভার সাতটি আসনের মাত্র দু’টি দখলে ছিল বিজেপির। অন্যতম পদ্ম-নেতা জিতেন্দ্র তিওয়ারি বলেন, “তৃণমূলের সন্ত্রাসের জন্য দলের কর্মীরা সে ভাবে নামতে পারেননি। সাধারণ মানুষকেও ওরা বুঝিয়েছিল, উপনির্বাচনে বিজেপি জিতলেও রাজ্য তৃণমূলের দখলেই থাকবে।” কিন্তু এ বারে তেমন হবে না বলেই দাবি জিতেন্দ্রের।

কিন্তু জিতেন্দ্রের প্রার্থী হতে না পারার ‘কাঁটা’ বিজেপিকে কতটা স্বস্তিতে রেখেছে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিজেপির নিচু তলার কর্মীদের একাংশ বলছেন, “জিতেনদা সারাজীবন আসানসোলে রয়েছেন। ওঁর সঙ্গে সকলের যোগাযোগ রয়েছে।” যদিও প্রকাশ্যে বিজেপি নেতাদের দাবি, দলের মধ্যে বিভাজন উস্কে দিতে তৃণমূল এ সব রটাচ্ছে। অন্য দিকে, আসানসোলে মন্ত্রী মলয় ঘটক বনাম তৃণমূলের অপর গোষ্ঠীর ‘সুসম্পর্ক’ সুবিদিত। অনেকেই মনে করছেন, সিবিআইয়ের ডাক পাওয়া মলয় অন্তরে কী চাইছেন, সেটাই এখন বড় ফ্যাক্টর। তৃণমূল নেতৃত্বও আবার একে বলছেন, ‘অপপ্রচার’।

তবে দুই দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে কয়লা চুরি, ধস-প্রবণ এলাকা নিয়ে মাথাব্যথা নেই সাধারণ মানুষের, বিশেষত মহিলাদের। পাণ্ডবেশ্বরের শ্রমিক মহল্লার এক মহিলার কথায়, “লক্ষ্মীর ভান্ডার বেড়ে এক হাজার টাকা হয়েছে। প্রত্যেক মাসে কে দেবে এই টাকা?” জামুড়িয়ার সত্তোরোর্ধ্ব বৃদ্ধার দাবি, “দিদি প্রতিমাসে বার্ধক্য ভাতা দেয়।” জোড়াফুল শিবির তাই রাজ্য সরকারের বিভিন্ন ভাতা ও প্রকল্পের কথা বেশি করেই প্রচার করে চলেছে শ্রমিক মহল্লায়। সব দেখে শুনে সুরেন্দ্র বলছেন, ‘মানুষ আপন, টাকা পর। যত পারিস মানুষ ধর’। দুই শিবিরের লড়াইয়ের মাঝে উপস্থিতি জানান দিতে মরিয়া হয়ে প্রচার সারছেন সিপিএমের প্রার্থী জাহানারা খান। তিনি বলছেন, “দুর্নীতিগ্রস্ত ওই দুই দলের গোপন আঁতাঁত মানুষ জেনে গিয়েছেন।”

জামুড়িয়ার কয়লাখনির শ্রমিক পরিবারের মেয়ের জয় নিয়ে আশাবাদী সিপিএমের পশ্চিম বর্ধমান জেলার সম্পাদক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, “আমরা লক্ষ্মীর ভান্ডারকে আক্রমণ করছি না। বাম আমলেও এমন প্রকল্প হয়েছে। তাই ছেলেমেয়েদের চাকরির দিকটি আমরা তুলে ধরছি।” তবে ১৭ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটের কতটা জাহানারার দিকে আসবে, সেটা যেমন তৃণমূলের মাথাব্যথা, তেমনই আবার বিজেপির ফায়দা বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা।

উপনির্বাচনে অবাঙালি, হিন্দিভাষী তথা শ্রমিক মহল্লার ভোটকে নিজেদের দিকে রাখতে ‘বিহারিবাবু’কে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। স্থানীয় বিজেপির নেতৃত্ব মনে করছেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সেই দিকে নজর রেখেই ‘ভূমিপুত্র’, অবাঙালি এবং ঝরঝরে বাংলা বলতে পারা সুরেন্দ্রকে প্রার্থী করেছেন। কিন্তু পদ্মশিবিরের দ্বিতীয় বারের সাংসদ বর্ধমান-দুর্গাপুরে কী কাজ করেছেন, সেই প্রসঙ্গ তুলে পাণ্ডবেশ্বরের তৃণমূল বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কটাক্ষ, “দুর্গাপুরে সাংসদ নিরুদ্দেশ বলে পুলিশে ডায়েরি হয়েছিল। সেখানকার মানুষ আর মেনে নেবেন না বুঝেই উনি আসানসোলে এসেছেন।”

যদিও রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ জানাচ্ছেন, আসানসোলে ছাত্র রাজনীতি করা সুরেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন পুরনো কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকেরা। কিন্তু সেই সমীকরণ ভোটে প্রভাব ফেলবে না বলেই দাবি তৃণমূলের। পাশাপাশি ‘মমতা-ম্যাজিক’ (বিভিন্ন প্রকল্প)-এ বাজিমাত করতে তাঁরা আশাবাদী। তবে, আসানসোলের ৪৮ শতাংশ বাঙালি ভোটের কতটা কার ঝুলিতে যাবে, আর তাতে কে এগিয়ে যাবে, সেই অঙ্ক কষতে ব্যস্ত শিল্পাঞ্চলের সব পক্ষই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement