—প্রতীকী ছবি।
বিপদে ভরসা সদাজাগ্রত নির্বাচন কমিশনের ‘চোখ’। চলতি লোকসভা ভোটে প্রথম থেকেই ওয়েবকাস্টিংয়ে বুথের ভিতরের ছবি কমিশন স্বচক্ষে দেখছে। ভোটারের সঙ্গে ফিসফাসের জন্য জনৈক প্রিসাইডিং অফিসারকে শো-কজ়ও করা হয়েছে। আর তা শুনে গত দু’দশক ধরে ভোটকর্মী রাঢ়বঙ্গের স্কুলশিক্ষকের মনে পড়ছে, এক যুগ আগে বাঁকুড়ার রানিবাঁধেই বিকেলের মুখে বুথে ঢোকা আদিবাসী মহিলা ভোটারদের সামলাতে সে কী গেরো!
মহিলারা ভোট-যন্ত্রের ব্যবস্থাপনা বুঝতে সমস্যায় পড়েছেন। আর শাসকদলের এজেন্ট সাহায্যের জন্য আকুল! এই অবস্থায় ভোটবাবু (প্রিসাইডিং অফিসার) নিজেই ডামি ভোটযন্ত্রের গায়ে আঁকা চিহ্নের মাহাত্ম্য বুঝিয়েছিলেন।
‘মূর্খ, দরিদ্র ভারতবাসীর’ কথা ভেবেই চেনা-জানা সব ছবির চিহ্ন বসিয়ে ভোট-ব্যবস্থা চালু করেন দেশের প্রথম নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন। কেশপুরের প্রবীণ তৃণমূল নেতা চিত্তরঞ্জন গরাই বললেন, “৫৭ সাল পর্যন্তও পোস্টকার্ডে ভোট হত। কংগ্রেসের জোড়া বলদ লেখা বাক্স, সিপিআই-এর কাস্তে হাতুড়ি বা জনসঙ্ঘের মাটির প্রদীপ আঁকা পছন্দের বাক্সে পোস্টকার্ড ফেললেই কাজ শেষ!”
২০১৭ সালের ‘নিউটন’ ছবিটি কিন্তু দেখিয়েছে, একুশ শতকেও এত শত ভোট-চিহ্নের মানে বোঝাতে হিমশিম ভোটকর্মীরা। ভোট বুথের সাধারণ এক প্রিসাইডিং অফিসারকে সেই প্রথম ‘নায়ক’ হিসেবে মেলে ধরে রুপোলি পর্দা। মালদহ থেকে বাঁকুড়া, বর্ধমানে ভোটের ডিউটি করা ভোটবাবু কিন্তু বলছেন, “স্রেফ মাওবাদী উপদ্রুত এলাকা কেন? অনেক আপাত শান্তিপূর্ণ তল্লাটেও প্রিসাইডিং অফিসারের দশা কম ফিল্মি নয়!” সিনেমায় মাওবাদী ঝুঁকির বুথে নাম-কা-ওয়াস্তে ভোটেই কাজ মেটাতে চেয়েছিল সিআরপি। ভোটবাবু ‘নিউটন কুমার’ কিন্তু ভোট দিতে ইচ্ছুক মুষ্টিমেয় ভোটারের আশা মেটাতে জীবনবিপন্ন করেন।
ভোট বুথের চক্রব্যূহে প্রভাবশালী এজেন্টদের মাঝে ভোটবাবুর লড়াই কম কঠিন নয়। বাম আমল থেকে একতরফা ভোটের জন্য কুখ্যাত আরামবাগ লাগোয়া কোতুলপুরের অভিজ্ঞতা। ২০১৬ সাল। মস্ত স্কুলবাড়ির বুথ। প্রিসাইডিং অফিসার দেখলেন, দুপুর থেকেই পর পর অ্যাম্বুল্যান্সে পিল পিল করে ভোটার ঢুকছেন। কিন্তু দেখে তো কাউকে রোগী বা অশক্ত মনে হচ্ছে না। কমিশনের নিয়ম মাফিক অশক্ত ভোটার হলে তাঁর সহায়ক লাগে। প্রতি অশক্ত ভোটারের জন্য আলাদা সহায়ক। তার নথি তৈরি করতে হয়। সেই নিয়মের কথা বলতেই ভোটারের সঙ্গীদের জোর গোঁসা। ওই প্রিসাইডিং অফিসার বলেন, “কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল বলেই রুখে দাঁড়াতে পেরেছিলাম। আমি সটান বলে দিই, অ্যাম্বুল্যান্স যেন স্কুল চত্বরে না-ঢোকে। তবে এর পরিণামে বিকেলেই ওই চত্বরের চায়ের দোকানে আমাদের বয়কট করা হয়। ভোট শেষ হতেই স্কুলবাড়ির গা ঘেঁষে বিরাট বোমা!” সে-যাত্রা হামলা এড়াতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের পরামর্শে বুথের বাইরে স্কুলবাড়ির মাঠে দাঁড়িয়ে কাগজ গোছান ভোটকর্মীরা। ভোটযন্ত্র ও ভোট নথি জমা দিতে বিষ্ণুপুরের ডিসিআরসি-তে জওয়ানেরাই পৌঁছে দিয়েছিলেন।
২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটেও লড়াই করে কেন্দ্রীয় বাহিনী জোগাড় করেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডে। তবে ভোটকর্মীরা বলেন, সে-বার বাহিনী মোতায়েনে নানা খামতি রাখে স্থানীয় প্রশাসন। কেন্দ্রীয় বাহিনীবিহীন ভোটে প্রিসাইডিং অফিসার আকছার শুনেছেন, বুথের মধ্যেই ভোটারদের উদ্দেশে প্রভাবশালী দলের এজেন্ট টিপ্পনী কাটছেন। ‘সামান্য ভোটের জন্য কলের জল আসা বন্ধ হবে, সেটা বোধহয় ভাল হবে না!’ তাঁর প্রশ্ন, ভোটকর্মীদের সুরক্ষা ছাড়া ওয়েবকাস্টিংয়ে কতটুকু লাভ হবে?ভোট প্রভাবিত করার এই চেষ্টা কবে থেকে শুরু হল? অতীত ঘাঁটলে কিন্তু অনেকটাই পিছোতে হবে। (চলবে)