গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
রাজ্যপাল, কুণাল ঘোষ, সন্দেশখালি— আগামী মঙ্গলবার তৃতীয় দফার ভোটের আগে তিন দফার ‘কৌশল’ নিয়ে রাজনীতির ময়দানে নামল তৃণমূল। এর মধ্যে দু’টি ক্ষেত্রে তারা ‘আগ্রাসী’ আক্রমণের রাস্তায় গিয়েছে। বাকি একটি ক্ষেত্রে তারা খানিকটা ‘রক্ষণাত্মক’। খানিকটা ‘সমঝোতা’র কৌশল নিয়েছে তারা। তবে তা-ও সামগ্রিক রাজনীতিরই স্বার্থে।
১. রাজভবনে কর্মীর যৌন হেনস্থা
গত বৃহস্পতিবার রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের বিরুদ্ধে পুলিশে যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছেন রাজভবনেরই এক অস্থায়ী মহিলা কর্মী। হেয়ার স্ট্রিট থানায় বসে তাঁর কান্নার ভিডিয়োও প্রকাশ্যে এসেছে। যে ভিডিয়োর কথা উল্লেখ করে শুক্রবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘দেখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে!’’ ওই বিষয়ে ইতিমধ্যেই অনুসন্ধান শুরু করেছে কলকাতা পুলিশ। রাজভবনের ওসির কাছে সিসিটিভি ফুটেজ চেয়েছে লালবাজার। এ হেন প্রেক্ষাপটে রাজ্যপালকে ‘ধর্ষক’ আখ্যা দিয়ে আগ্রাসী প্রচার শুরু করেছে তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা নির্বাচনী জনসভা থেকে রাজ্যপালকে চাঁছাছোলা আক্রমণ শানিয়েছেন নির্বাচনী জনসভা থেকে। পাশাপাশিই তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, রাজ্যপালের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরেও কী ভাবে সে দিন রাজভবনে থাকলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী!
আর রাজ্যপালের উদ্দেশে তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘শ্লীলতাহানি করে রাজ্যপাল পালিয়ে গিয়েছেন! দোষ না থাকলে তদন্তে সহযোগিতা করুন।’’
রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলার ‘অবনতি’ হয়েছে বলে সরব হয়ছেন রাজ্যপাল। সরব হয়েছেন বাংলার মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়েও। সরকার-বিরোধী সুর ধরে রেখেই রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান একের পর এক বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের অভিযোগকে রাজ্যপাল ‘মিথ্যা’ তো বটেই, ‘সাজানো’ বলেও অভিহিত করেছেন। শুক্রবার তিনি নিজের রাজ্য কেরলে গিয়েছেন (সেই কারণেই অভিষেকের ‘পলাতক’ কটাক্ষ)। কিন্তু যাওয়ার আগে একটি বার্তায় বলে গিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’ করতে তাঁর লড়াই চলবে। কিন্তু শাসকদল বারংবারই বিষয়টি প্রচারের মূল বিষয় করে নিচ্ছে। তৃতীয় দফা ভোটের আগে সেই প্রচার আরও জোরালো হয়েছে।
২. সন্দেশখালির ভিডিয়ো
রাজ্যপাল নিয়ে রাজনৈতিক আক্রমণ চালাতে চালাতেই শনিবার তৃণমূলের হাতে এসে পড়েছে একটি গোপন ক্যামেরা অভিযানের ভিডিয়ো (ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন)। সেখানে সন্দেশখালি-২ ব্লকের বিজেপি নেতা গঙ্গাধর কয়ালকে বলতে শোনা যাচ্ছে, সন্দেশখালিতে মহিলাদের দিয়ে জোর করে ধর্ষণের অভিযোগ করানো হয়েছিল। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী কী ভাবে টাকা, অস্ত্র দিয়ে সন্দেশখালিকে উত্তপ্ত করতে চেয়েছেন, সে সবও গঙ্গাধরের মুখে শোনা যাচ্ছে। কালক্ষেপ না-করে ওই ভাইরাল ভিডিয়ো নিয়ে মাঠে নেমেছে শাসকদল। শনিবার রানাঘাটের সভা থেকে মমতা বলেছেন, ‘‘সন্দেশখালি নিয়ে ভাল নাটক তৈরি করেছিলেন। আসল তত্ত্ব ফাঁস! অনেক দিন ধরে বলছিলাম, এটা পরিকল্পনা, বিজেপির তৈরি করা নাটক। ফাঁস হয়ে গিয়েছে। আমি ডিটেলস দেখিনি। নিশ্চয়ই দেখব।’’ পাশাপাশিই অভিষেক গোটা বিষয়টিকে বাংলা-বিরোধী আখ্যান লেখার বিজেপির ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন। অভিষেক বলেছেন, ‘‘বিজেপির নেতারা বলতেন, সন্দেশখালি করবে তৃণমূলের চেয়ার খালি। আর এই ভিডিয়ো বুঝিয়ে দিয়েছে বিজেপি দলটাই জালি!’’
৩. কুণালে প্রলেপ
রাজ্যপাল এবং সন্দেশখালি নিয়ে তৃণমূল যেমন আগ্রাসী পন্থা নিয়েছে, তেমনই তৃতীয় ক্ষেত্রে তারা এক পা পিছিয়ে দু’পা এগোনোর নীতি নিয়েছে। শনিবার মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর মধ্যস্থতায় ‘বিক্ষুব্ধ’ নেতা কুণাল ঘোষের সঙ্গে রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনের বৈঠক হয়েছে। সম্প্রতি ‘দলবিরোধী’ কার্যকলাপের জন্য একটি প্রেস বিবৃতি দিয়ে ডেরেক জানিয়েছিলেন, কুণালকে আগেই দলের মুখপাত্রের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। এ বার তাঁকে রাজ্য সম্পাদকের পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হল। তার পরেই কুণাল ডেরেকের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আক্রমণ শুরু করেছিলেন। যা এই ভোটের আবহে তৃণমূলের কাছে যথেষ্ট ‘অস্বস্তিজনক’ ছিল। ফলে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব হস্তক্ষেপ করেন। যার ফলে ব্রাত্যের উপস্থিতিতে কুণাল ডেরেকের সামনে বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার নেত্রী। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আমার সেনাপতি। আমি তৃণমূল পরিবারের এক জন সৈনিক। আমি দলে ছিলাম, আছি, থাকব।’’ তবে অভিষেককে ওই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছেন, ওই বৈঠকের বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই। দল মনে করেছিল বলে কুণালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তিনি ওই পর্যন্তই জেনেছেন। ফলে কুণালের মুখপাত্র, রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বা তারকা প্রচারকের পদ বা দায়িত্ব ফিরে আসবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু আপাতত কুণালের উপরে ‘শান্তিবারি’ বর্ষণ করা গিয়েছে বলেই মনে করছেন দলের নেতারা।
সাধারণ ভাবে রাজনীতিতে ধারণাই সব। রাজনৈতিক দলগুলি সেই ধারণাই নির্মাণ করে। তৃতীয় দফার ভোটের আগে তৃণমূলও তিন দফায় ধারণা নির্মাণে ময়দানে নেমেছে। প্রথম, যিনি সাংবিধানিক পদে থেকে সরকারের সমালোচনা করেন, মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে মুখ খোলেন, সেই রাজ্যপালের বিরুদ্ধেই যৌন নিগ্রহের অভিযোগ! দুই, যে সন্দেশখালি নিয়ে তৃণমূলের এত বিরোধিতা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এসে যে কথা প্রতিটি সভা থেকে বলছেন, তা আসলে সাজানো। এবং তিন, কুণাল ঘোষ। আপাতত তাঁরও মানভঞ্জন করা গিয়েছে।
আশ্চর্য নয় যে, তৃণমূলের মুখপাত্র শান্তনু সেন বলছেন, ‘‘রাজ্যপাল যে বিজেপির মুখপাত্র, সেটা বাংলার মানুষ জানেন। সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে ধারাবাহিক কুৎসা হচ্ছিল, সেটাও ফাঁস হয়ে গিয়েছে। নিশ্চিত ভাবেই মানুষ সবটা দেখেই ভোট দেবেন যে, কোথায় মহিলারা আক্রান্ত আর কোথায় সবটা সাজানো। তবে কুণাল ঘোষের বিষয়টি একেবারেই দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’’ পক্ষান্তরে, বিজেপির মুখপাত্র তরুণজ্যোতি তিওয়ারির বক্তব্য, ‘‘গোটা বাংলা জানে তৃণমূল চোর। তারা তৃণমূল মা-বোনেদের ইজ্জত নিয়েছে। সুতরাং হঠাৎ কোনও ভিডিয়ো দিয়ে মানুষকে ভুল বোঝানো যাবে না। রইলেন পড়ে কুণাল ঘোষ। গোটা বাংলা জানে, কুণালদাই বলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সারদাকাণ্ডে গ্রেফতার করা উচিত।’’ সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শমীক লাহিড়ির বক্তব্য, ‘‘এত আয়োজন আসলে নতুন করে তৃণমূল-বিজেপি দ্বিমেরুকরণের লক্ষ্যে। তৃণমূল এবং বিজেপি দেখতে পাচ্ছে যে, সেই বাইনারি ভাঙতে শুরু করেছে। ভেঙে যাচ্ছে। যা হচ্ছে সব ওদের পারস্পরিক বোঝাপড়া।’’