আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী পবন সিংহ। —ফাইল চিত্র।
আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী হয়েছেন ভোজপুরি সিনেমার নায়ক-গায়ক তথা সুপারস্টার পবন সিংহ। এই লোকসভা কেন্দ্র ফিরে পেতে বিহারের বাসিন্দা পবনকে হাতিয়ার করেছে পদ্মশিবির। আসানসোলে তৃণমূলের সম্ভাব্য প্রার্থী বিদায়ী সাংসদ অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিংহ। যাঁর রাজনীতিতে পরিচয় ‘বিহারীবাবু’ হিসাবে। ৭৭ বছরের সেই ‘বিহারীবাবু’র জবাব হিসেবে বছর ৩৮-এর অভিনেতাকে বেছে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহেরা। শনিবার সন্ধ্যায় দিল্লি থেকে পবনের নাম ঘোষিত হতেই আক্রমণে নেমে পড়েছে বাংলার শাসকদল তৃণমূল। মূলত অভিযোগ আনা হচ্ছে বাংলার নারীদের প্রতি পবনের ‘দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে। তৃণমূল মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী নিজের এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) অভিযোগের সুরে লিখেছেন, ‘‘ভোজপুরিতে প্রকাশিত পবনের বিভিন্ন গান এবং ভিডিয়োতে বাংলার মহিলাদের প্রতি অশালীনতা প্রকাশ পেয়েছে।’’ তৃণমূলের আরও এক মুখপাত্র ঋজু দত্ত আবার নিজের এক্স হ্যান্ডেলে এক ভোজপুরি অভিনেত্রীর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘ভোজপুরি অভিনেত্রী অক্সরা সিংহ আসানসোলের মানুষকে কিছু বলতে আসবেন। অপেক্ষা করুন।’’
ভোটের ফলাফল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত যে তৃণমূলের এই আক্রমণ চলবে, তা বোঝা গিয়েছে রবিবার সকালেও। তৃণমূলের প্রতীকে রাজ্যসভা নির্বাচনে সদ্যজয়ী সাংবাদিক সাংসদ সাগরিকা ঘোষ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘নহম হাসিনা বাঙ্গাল কি। আসানসোলের বিজেপি প্রার্থীর একটি গানের ভিডিয়োতে বাংলার নারীদের নিচু করে দেখানো হয়েছে। আমরা কি এই ধরনের জনপ্রতিনিধি পেতে চাইব?’’ ভোট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তৃণমূলের এমন আক্রমণ বিজেপির চিন্তা বাড়িয়েছে বলেই বাংলার রাজনীতি কারবারিদের একাংশ মনে করছেন। সেই আগুনে ঘৃতাহতি দিয়েছে বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের মন্তব্য। নিজের এক্স হান্ডেলে আসানসোলের বিজেপি প্রার্থীবদলের দাবি তুলে দিয়েছেন তিনি। সঙ্গে তিনি লিখে দিয়েছেন, ‘‘আসানসোল কিন্তু বিহারে নয়।’’
তৃণমূলের আক্রমণের জবাব দিয়েছেন বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ তথা মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘আসানসোলের ভোটের লড়াইয়ের আগেই তৃণমূল হেরে গিয়েছে। তারা বুঝে গিয়েছে যে, বিহারীবাবুকে দিয়ে এ বার আর ভোট বৈতরণী পার হবে না। তাই আগে থাকতেই ব্যক্তিগত কুৎসা করতে নেমে পড়েছে ওরা। তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে ব্যক্তিগত কুৎসা কোনও নতুন বিষয় নয়। যে পথ ধরে তাঁরা এগিয়ে চলেছেন, এটা তার নতুন সংযোজন। এই পথ ধরে তারাঁ যত বেশি এগোবেন ততই তাঁদের বাংলা থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার দিন এগিয়ে আসবে।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে বাবুল সুপ্রিয় যে ব্যবধানে জিতেছিলেন, পবন তার চেয়ে অনেক বেশি ভোটের ব্যবধানে তৃণমূল প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হবেন।’’ তবে দলের বর্ষীয়ান নেতা তথাগতের মন্তব্য প্রসঙ্গে কোনও জবাব দিতে চাননি শমীক। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে গায়ক বাবুলকে প্রার্থী করে প্রথম বার আসানসোল দখল করে বিজেপি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ১ লক্ষ ৯৭ হাজার ভোটে তৃণমূল প্রার্থী মুনমুন সেনকে হারিয়ে দ্বিতীয় বারের জন্য সাংসদ নির্বাচিত হন বাবুল। জায়গা পান কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায়। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিপর্যয়ের পর বাবুলকে মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। ক্ষোভে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগদান করেন গায়ক-রাজনীতিক। পদত্যাগ করেন আসানসোল লোকসভার সাংসদ পদ থেকে। উপনির্বাচনে শত্রুঘ্নকে প্রার্থী করে তিন লাখ ভোটে প্রথম বারের জন্য আসানসোল জিতে নেয় তৃণমূল। সেই আসন ফিরে পেতে বিহারের আড়া জেলার বাসিন্দা জনপ্রিয় অভিনেতা পবনকে ময়দানে নামিয়েছে বিজেপি। আর তাঁর নাম ঘোষণা হওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়েছে তৃণমূল-বিজেপির মধ্যে।
তবে বাংলার রাজনীতিতে গায়ক-নায়ক পবন প্রথম ব্যক্তি নন যিনি নিজের পেশা এবং ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আক্রমণের সম্মুখীন হচ্ছেন। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করেন গায়ক কবীর সুমনকে। তৎকালীন সিপিএম সাংসদ সুজন চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে ময়দানে নামেন ‘নাগরিক কবিয়াল’। সেই ভোটে সুমনের ব্যক্তিগত জীবন এবং পেশাকে নিজেদের ভোটের প্রচারে ব্যবহার করেছিল বামফ্রন্ট তথা সিপিএম। কিন্তু সেই প্রচারকে ছাপিয়ে সর্ব ক্ষণের রাজনীতিক সুজনকে হারিয়ে ৫৬ হাজারের বেশি ভোটের জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী সুমন। আর এ বার সেই তৃণমূল একই কায়দায় ভোজপুরি নায়ক পবনকে আক্রমণে নেমেছে। এই প্রচারের ফলে কি যাদবপুরের পুনরাবৃত্তি ঘটবে? না কি বিহারী গায়ক-নায়ককে হারিয়ে জয়ী হবেন তৃণমূলের প্রবীণ ‘বিহারীবাবু’? জবাব দেওয়ার দায়িত্ব আসানসোলের জনতার।