Lok Sabha Election 2024

অহরহ ডি-ভোটার, খাটতে হচ্ছে জেলও, তবু আস্থা বাঙালির

বড় আশায় বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন বাঙালিরা। কিন্তু সেই আমলেই তো এত ঝামেলা পোয়াচ্ছেন। বাঙালিদের সমস্যার সমাধান তো হল না। তা হলে?

Advertisement

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

মরিগাঁও (অসম) শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:২০
Share:

এনআরসিছুট সুশীল ও সুরধনী। —নিজস্ব চিত্র।

আঁচলের গিঁট খুলে গৃহকর্ত্রী বার করে আনলেন ১০ টাকার নোট। মলিন। কিন্তু আদর ঝলকানো! ততক্ষণে শেষ পাতের দই-গুড় শেষ করে নামিয়ে রেখেছি বাটি। তার আগে একে একে এসেছে ছাতু-দই, মুড়কি, ঢ্যাপের মোয়া। আপত্তি উড়িয়ে পাতে পড়েছে ভাত, নিমপাতা ভাজা, সুক্তো, তেতোর ডাল। দোহাই দিয়েছেন নিয়মের। এ বার ১০ টাকা নিয়ে এগিয়ে আসতেই বেজায় সঙ্কোচে বলে উঠি, “না না এ কী! টাকা কিসের!” মিঠে শাসনে ভবানী মণ্ডল বলেন, “সংক্রান্তির দিন এসেছেন। তা-ও দেশের মানুষ। খালি হাতে ফেরাতে নেই যে! এটা রাখতেই হবে।”

Advertisement

সাধারণত চর বা দরিদ্র বাঙালি এলাকার দুর্দশা, অবিচারের কাহিনিচিত্র তুলে ধরতে গেলে লেখার ধরতাইতেই থাকে ডিটেনশন সেন্টার বা এনআরসির উল্লেখ। কিন্তু মারিগাঁওয়ের ভুরাগাঁওতে শোনডোবা বিলের পাড়ে বসা মাটির ঘরের দাওয়ায় এমনই এক মায়া বোনা হল, যেখানে দারিদ্র ও দুর্দশাকে আগলে রেখে জিতে গেল স্বাভিমানী আতিথ্যের বন্দিশ।

গাড়ি যায় না সেই বাড়ি পর্যন্ত। ফি বছর বানভাসি ঘরগুলোর ক্ষয়াটে মলাটই বলে দেয়, এই এলাকায় শুধু পাট ছাড়া, পাটভাঙা প্রায় কিছুই নেই। বরডোপাটুপ, বটালিমারি, ভকুয়ামারি গ্রামগুলোর প্রতি ঘরেই তো বাঙালনামা। অধিকাংশেরই উৎস ময়মনসিংহ বা টাঙ্গাইল। অধিকাংশের নামই হয় ওঠেনি এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায়, না হলে ডি-ভোটারের তকমা জুটেছে কপালে। অথবা কেউ ডিটেনশন সেন্টার ফেরত।

Advertisement

এলাকার এক বাঙালি ডাক্তার বলছিলেন, এখানকার মানুষের মূল সমস্যা ছিল, তাঁরা বড় নিশ্চিন্ত ছিলেন। ভাবেননি, ফের কখনও তাঁদের ছিন্নমূল হতে হবে।

ময়মনসিংহের সুশীল বর্মণ বাবার সঙ্গে ১৯৪৬ সালেই চলে এসেছিলেন নগাঁওয়ে। ১৯৬০ সালে এসে বসতি গড়া ব্রহ্মপুত্র লাগোয়া এই গ্রামে। বিয়ে হয় কোচবিহারের ছিন্নমূল পরিবারেরই মেয়ে সুরধনীর সঙ্গে। তিন ছেলেমেয়ে। পরিবারের কারও নামই নেই এনআরসিতে। কারণটা অদ্ভুত! সুশীলের বাবার নাম আগেই অন্য কেউ ব্যবহার করে ফেলেছেন নিজের বাবার নাম হিসেবে! স্ত্রী সুরধনীর কোচবিহারের ‘সার্টিফিকেট অব রেজিস্ট্রেশন’ বাংলা থেকে যাচাই করে পাঠানো হয়নি। সারা অসম বাঙালি পরিষদের নেতা ইন্দ্রজিৎ দাসের মতে, ৮ লক্ষ এনআরসিছুট বাঙালির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নথি যাচাই না হওয়ার খেসারত দিচ্ছেন প্রায় পাঁচ লক্ষ।

বড় আশায় বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন বাঙালিরা। কিন্তু সেই আমলেই তো এত ঝামেলা পোয়াচ্ছেন। বাঙালিদের সমস্যার সমাধান তো হল না। তা হলে? সুশীলবাবু অনড়, “মোদী নিশ্চয়ই পরের বার কোনও একটা ব্যবস্থা করবেন।” যদি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয় তাঁকে? সুশীল বলেন, “আপত্তি নেই। আমার মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট রয়েছে। অস্বীকার তো করছি না বাংলাদেশ থেকে এসেছি।”

স্থানীয় বাঙালি পরিষদের নেতারা জানাচ্ছিলেন, নগাঁওয়ের ১৭ লক্ষ ভোটারের মধ্যে সীমানা পুনর্বিন্যাসের পরেও ৩ লক্ষাধিক বাঙালি। গত বার সংখ্যালঘু ভোটে নগাঁও জিতেছেন কংগ্রেসের প্রদ্যোৎ বরদলৈ। এ বার নগাঁওয়ের জেলা কংগ্রেস সভাপতি সুরেশ বরাকেই দলে টেনে প্রদ্যোতের বিরুদ্ধে নামিয়েছে বিজেপি। প্রদ্যোতের মুসলিম ভোট অনেকটাই কাড়বেন ইউডিএফের আমিনুল ইসলাম। তাই নগাঁও আসনে লড়াই জমাটি।

ভুরাগাঁও থেকেই লঞ্চে যাতায়াত করতে হয় চরবাসী বাঙালিদের। তাঁদের লড়াই শুধু প্রশাসন নয়, প্রকৃতির সঙ্গেও। কারণ, ১৯৬০-এর দশকে তাঁরা চরের যে জমি নিয়েছিলেন, দলিল তৈরি করেছিলেন, সেই জমিই তো এখন নদীর গর্ভে।

বাঙালিরা এখানে ডি-ভোটার হচ্ছেন নাগাড়ে। দিতে হচ্ছে থানায় হাজিরা। জমির পাট্টা পাচ্ছেন না। কিন্তু তারপরেও কেন মোহ পদ্ম-প্রতীকে! বাঙালি পরিষদের এক নেতা জানান, কারণ, দেশছাড়ার সময়ের অত্যাচার তাঁদের স্মৃতিতে টাটকা। তাই জেল থেকে ফিরেও বিজেপিকেই ভোট দেবেন।

শোনডোবা বিলের সামনে গোপাল মণ্ডলের মাটির বাড়ি। লাঠি ভর দিয়ে বেরোন গোপাল। ছেলেরা জানান, ২০০৮ সালে প্রথম ডি ভোটারের নোটিস এসেছিল। পাত্তা দেননি তাঁরা। কারণ, বাবা তো বরাবর ভোট দিচ্ছেন বটালিমারিতে। ২০১৩ সালে বাড়িতে পুলিশ এলে টনক নড়ে। উকিল ধরেন। ২০১৫ সালে পুলিশ বাড়িতে এসে অসুস্থ গোপালকে গোয়ালপাড়া ডিটেনশন কেন্দ্রে নিয়ে যায়। জানা যায়, আদালতে পর পর হাজিরার তারিখ পার হয়েছে। উকিল খবরই দেননি। একতরফা রায়ে বিদেশি ঘোষিত হয়েছেন গোপাল মণ্ডল। মাথায় বাজ পড়ে পরিবারের। হাইকোর্টে মামলা ওঠে। জামিন পান। কিন্তু মামলা চলতে থাকে। ফের ২ দফায় হাজিরা না দেওয়ায় আবেদন বাতিল গোপালের। অথচ পরিবারকে নিঃস্ব করে উকিলরা তত দিনে চার লক্ষ টাকা পকেটে পুরেছে।

২০১৭ সালে তেজপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। তবে কোভিডপর্বে সুপ্রিম কোর্ট ২ বছরের বেশি বন্দি থাকা ডি-ভোটারদের জামিনে মুক্ত করার নির্দেশ দেয়। ২ বছর ৭ মাস পরে বাড়ি ফেরেন গোপাল। আগে থেকেই কমজোরি পা তত দিনে নাড়াতেই পারছেন না। ইতিমধ্যে মা গত হয়েছেন। কিন্তু জেলের নিয়ম, খুনিরা প্যারোল পেলেও ডি-ভোটারের প্যারোল মঞ্জুর হয়নি। গোপালের স্ত্রীর নামে রেশন কার্ডও রহস্যজনক কারণে বাতিল হয়েছে। নাতি-নাতনির আধার কার্ডও হচ্ছে না।

মজা হল, আদালত স্বীকৃত ভাবেই গোপাল মণ্ডল এখন ঘোষিত বিদেশি। অথচ তার পরেও দু’বার বিধানসভা ও এক বার লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। এ বারেও দিতে তৈরি। পদ্মে। এত হেনস্থার পরেও? উদাসীন উত্তর, “আর কারে দিব!”

ফেরার পথে চড়ক মেলায় হাজার বাঙালির ভিড়! পদপ্রদর্শক আক্ষেপ করছিলেন, এই বিরাট ভোটব্যাঙ্কের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল অনৈক্য ও অজ্ঞানতা। বাঙালির কোনও যৌথ মঞ্চ নেই। সংগঠনগুলোর নিজেদের মধ্যেই খেয়োখেয়ি। তথাকথিত নেতারা ভাষণ দেওয়ায় দড়, কিন্তু সমস্যার গভীরে যেতে, আইন পড়তে আগ্রহী নন। বাঙালিও নিজের ঘরে আগুন না লাগা পর্যন্ত নড়তে নারাজ। তাই পথপ্রদর্শকের কথায়, আত্মসুখী ও আত্মঘাতী ভোটব্যাঙ্ককে হুমকি দিয়ে, ভয় দেখিয়ে, দমিয়ে রাখার জন্য অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement