ডিসেম্বর ছিল কলকাতায় ‘প্রাইড ওয়াক’-এর মাস। এ বছর এই মিছিল হল ১৫ ডিসেম্বর, কিন্তু মাসের শুরু থেকেই সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের উদ্যোগে সাড়া দিয়ে সকল লিঙ্গযৌনতার মানুষ নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন। নাটক, নাচ-গান, আলোচনা, শিল্প প্রদর্শনী, মেলার বিকিকিনি, কিছুই বাদ ছিল না। ভারতের অনেক অংশে এলজিবিটিকিউআইএ+ গোষ্ঠীর মানুষদের নিজেদের মতপ্রকাশের পরিসর অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ, প্রাইড ওয়াক-এর অনুমতিই মেলে না। সেখানে কলকাতায় পুলিশ আধিকারিকরা দাঁড়িয়ে থেকে ভিন্ন লিঙ্গযৌনতার উদ্যাপনের মিছিল এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। প্রতি বছর এই শোভাযাত্রার কলেবর বাড়ছে। আন্দাজ হয়, রাজ্য সরকার যৌনসংখ্যালঘু মানুষদের অধিকার রক্ষার গুরুত্ব বোঝে। তা ছাড়া, প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষদের উপর হিংসা-হেনস্থার কোনও ঘটনা ঘটলে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি হয়। প্রকাশ্য রাজপথে এবং সামাজিক মাধ্যমেও প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। এ রাজ্যে প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষদের স্বাধীন জীবনযাপন, আপন মতপ্রকাশের ছবিটা খুব উজ্জ্বল না হলেও, একেবারে ধূসরও নয়।
কেবল ভারতে নয়, সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে প্রথম প্রাইড ওয়াক সংগঠিত হয়েছিল এই কলকাতাতেই, ১৯৯৯ সালে। তখন তার নাম ছিল ‘ফ্রেন্ডশিপ ওয়াক’। প্রধানত ইংরেজি সংবাদপত্রগুলিতেই ওই মিছিলের উল্লেখ ছিল। তবে ওই জমায়েত তার পরে খুব নিয়মিত সংগঠিত হয়নি। এর পরে কলকাতায় বিভিন্ন ধরনের আরও অনেক প্রাইড ওয়াক সংগঠিত হয়েছে। নানা দাবি নিয়ে প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষদের অনেক সংগঠনও তৈরি হয়েছে, সেগুলি নানা ভাবে ভিন্ন লিঙ্গযৌনতার উদ্যাপন করেছে। তবে প্রাইড ওয়াক বিশ্বের প্রায় সব দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি পেয়েছে। আজও বিসমকামিতাকেই ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে চলে অধিকাংশ সমাজ। তাই বিভিন্ন লিঙ্গযৌনতার মানুষ যখন জড়ো হন এবং একে অপরের সঙ্গে পা মেলান, তখন পোশাক-পরিচ্ছদের অধিকার থেকে শুরু করে সব ধরনের যৌনতা বিষয়ে, সকলের মানবাধিকার বিষয়ে সমাজের বাকি মানুষদের পূর্বকল্পিত ধারণা ভেঙে যায়। এ সব বিষয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র নির্ধারিত সংজ্ঞার সীমানা প্রশস্ত হয়।
বিচিত্র ফ্যাশন, মেক-আপ, গান-বাজনার সঙ্গে অনেক লোকজনকে আনন্দ করে হাঁটতে দেখলে মনে হতে পারে, এ তো কার্নিভাল, প্রতিবাদ কোথায়? ওই সাজপোশাক, ওই প্ল্যাকার্ড, ওগুলোই চলমান প্রতিবাদ। প্রাইড ওয়াক একটি রাজনৈতিক মিছিল। এর রাজনীতি ত্রিমুখী। প্রথম বিরোধ রাষ্ট্রের সঙ্গে, যা কেবলমাত্র লিঙ্গযৌনপরিচয়ের কারণে নাগরিককে নানা অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায়। দ্বিতীয় লড়াই বিসমকাম-পন্থী সমাজের সঙ্গে, যা নিজের মতো লিঙ্গ-যৌনতার সামাজিক সংজ্ঞাগুলি নিরূপণ করে নেয়, প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষদের এক চিলতে জমি ছাড়ে না। বিরোধিতার তৃতীয় অভিমুখ নিজের দিকে। বিভিন্ন লিঙ্গযৌনতার মানুষদের মধ্যেকার সংঘাত, আধিপত্যকামী আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও প্রাইড ওয়াক-এর অন্যতম লক্ষ্য।
এলজিবিটিকিউআইএ+ মানুষেরা সংখ্যালঘুত্বের চেতনায় একই ছাতার তলায় থাকলেও, বহু সময়ে একটি গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে। প্রাইড ওয়াক-এর মধ্যেই এক সময় ‘ঠিকরি’ (হিজড়া পেশার মানুষদের বিশেষ তালি) নিষিদ্ধ ছিল। অনেক সময় সমকামী-রূপান্তরকামী পুরুষদের জমায়েতে লেসবিয়ান মানুষরা সহজ হতে পারেননি, স্বস্তি পাননি। বিভিন্ন লিঙ্গযৌনতার মানুষদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানও তাঁদের একে অপরের থেকে দূরে ঠেলেছে। শহরের ইংরেজিতে কথা-বলা সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের সঙ্গে গ্রামের অনুরূপ মানুষদের সামাজিক দূরত্ব একই রয়ে গিয়েছে। যৌনসংখ্যালঘুত্ব সেই ব্যবধান ঘোচাতে পারেনি। বিসমকামী সমাজের ঢঙে, এলজিবিটিকিউআইএ+ মানুষদের নানা গোষ্ঠীও একে অপরের জীবনযাপন নিয়ে তির্যক মন্তব্য করে বসেন। লিঙ্গযৌনতা যে একটি চলমান ধারণা, কোনও একটা বিশেষ বিন্দুতে তা থেমে যাওয়ার নয়, তা যৌনসংখ্যালঘু মানুষদের কেউ কেউ বুঝতে চান না। তাঁরা বিসমকামী মানুষদের ভাষায় কথা বলেন, অনেকটা যেন অত্যাচারীর ভাষা ধার করে।
আরও একটি নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে। বিপণন-উন্মুখ কর্পোরেট দুনিয়া প্রায় যে কোনও উপলক্ষে বহু মানুষের সমাবেশ ঘটলেই তাকে নিজের কাজে লাগাতে চায়। প্রতিবাদী আন্দোলনকেও এমন ভাবে বিজ্ঞাপিত করে, যেন তা জনমতের মূলস্রোতে এসেই গিয়েছে, এখন কেবল উদ্যাপনের অপেক্ষা। এবং সেই উদ্যাপন হতে হবে সবার জন্য এক রকম। ‘প্রাইড-ওয়াক’-এর ‘কর্পোরেট’ হয়ে ওঠার প্রবণতা সারা বিশ্বেই লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু তাতে প্রান্তিক মানুষের গ্রহণযোগ্যতা আদৌ বাড়ে কি না, ভেবে দেখতে হবে নতুন প্রজন্মের এলজিবিটিকিউআইএ+ আন্দোলনকারীদের। প্রতিবাদের পণ্যায়ন নানা ধরনের সঙ্কট বয়ে আনে। এ বিষয়ে মতামতে প্রজন্মগত ব্যবধান থাকবে, সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু প্রতিকূল সময়ে এ দেশে আন্দোলনের রশি যাঁরা হাতে তুলে নিয়েছিলেন, তাঁদের অবস্থান ভুলে যাওয়া চলে না।
এ সব চ্যালেঞ্জের সামনে প্রাইড ওয়াক-এর কর্মকাণ্ডে অনেক বদল এসেছে। ভারতের নানা রাজ্য ও শহরে অনেক বেশি প্রাইড ওয়াক এখন সংগঠিত হয়। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বিলুপ্তির পর দেশে এলজিবিটিকিউআইএ+ মানুষদের দৃশ্যমানতা বেড়েছে। নতুন প্রজন্ম যুক্ত হয়েছে। সব ধরনের মানুষ বেশি করে লিঙ্গযৌনতা সম্বন্ধে নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারছেন। নারী, পুরুষ, সকলেই যোগ দিচ্ছেন প্রাইড ওয়াকে। তবু ভুলে গেলে চলে না, সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের লিঙ্গযৌনতা সমাজে আজও প্রান্তিক, ‘প্রাইড-ওয়াক’ আসলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন। সলিল চৌধুরী লিখেছিলেন, “পথে এবার নামো সাথী পথেই হবে পথ চেনা/ জনস্রোতে নানান মতে মনোরথের ঠিকানা/ হবে চেনা হবে জানা।” প্রাইড ওয়াক-এ ভিন্ন মতকে স্বাগত জানিয়েই আন্দোলনের রাস্তা আরও মজবুত করতে হবে।