নভেম্বরের শেষে কাগজে পড়লাম হুগলির খেতমজুর পরিবারের যে চার বছরের কন্যাটি ধর্ষিত ও নিহত হয়েছে, তার মা বলেছেন, ‘এত বড় হাসপাতালে দিদি মারা গেল, তার বিচার এখনও দিতে পারল না। আমাদের মতো সাধারণ ঘরের মানুষ কি বিচার পাবে!’ (আবাপ ২৬-১১)।
ওই শিশুকন্যাটির মায়ের বক্তব্য উদ্ধৃত করলাম দু’টি কারণে। এক, শহরের বড় হাসপাতালের যে ডাক্তার-মেয়েটি ধর্ষিত ও খুন হওয়ার পর আমরা ১৪ অগস্ট থেকে কিছু দিন মেয়েদের ‘রাত দখল’ আন্দোলন দেখেছি, সেই আন্দোলন আমাদের রাজ্যের রাত থাকতে কাজে বেরোনো মেয়েদের ও স্কুল/কলেজ/কাজের জায়গা থেকে পায়ে হেঁটে/ ট্রেনে/ বাসে বাড়ির ফেরা মেয়েদের কতটা স্পর্শ করেছিল সেটা তুলে ধরার জন্য। ওই শিশুকন্যাটির মায়ের মতো অনেক প্রান্তিক পরিবারের মেয়েদের বলতে শুনেছি যে, আজ একটা ডাক্তার-মেয়ে যদি বিচার না পায় তা হলে আমাদের মেয়েদের কী হবে? তাই আমরাও যাব।
বাড়ি ফেরার পথে যাঁদের রাস্তায় আলো থাকে না, অথচ মদ-জুয়া-তাসের আড্ডার পাশ দিয়ে রোজ ভয়ে কুঁকড়ে ফিরতে হয়, একটা অসহায়তা ও গভীর বেদনার জায়গা থেকেই তাঁরা নিজেদের এলাকায় নিজেদের মতো করে সন্ধে দখল/ রাত দখলের উদ্যোগ অথবা যোগ দিয়েছেন। আমি জানি অনেক জায়গাতে তাঁরা রাজ্যের শাসক দলের আঞ্চলিক কর্মী হয়েও রাত দখলে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা শাসক দলের কর্মী অথবা সেই দলের ভোটার মানেই যে তাঁরা একটা ঘোরতর অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের দাবিতে একাত্ম হতে পারবেন না, এটা আমরা ধরে নিচ্ছি কেন? তাঁদের কি ভোটারসত্তা ছাড়া আর কোনও সত্তা নেই?
নানা সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা, কাজের জায়গায় শৌচালয় ও ক্রেশের মতো ন্যূনতম অধিকারগুলো না পাওয়ার কষ্ট মুখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য হয় যে নারীসত্তা, তা কি ধর্তব্যের মধ্যেই নয়? না কি তাঁদের ভোটারসত্তা ছাড়া আর কোনও সত্তা নিয়ে দলীয় রাজনীতির কারবারিদের মাথাব্যথা নেই, ভোটের বাক্সে যত ক্ষণ না বদল ঘটছে তত ক্ষণ থোড়াই কেয়ার! অনায়াসে বলে দেওয়া যায় অল্পবিত্ত মেয়েদের এই আন্দোলনে কিছু যায় আসে না।
‘রাত দখল’-এর ডাক এ বার যে-হেতু সোশ্যাল মিডিয়ায় চারিদিক ছেয়ে যাওয়া যুগে মুঠোফোনের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে গেছে জনতার মধ্যে এবং সেই ডাকে সহজবোধ্য বাংলা ব্যবহার হয়েছে, অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছেন সব স্তরের মেয়েরা। এইখানে একটু ১১-১২ বছর আগের ‘রাত দখল’-এর সঙ্গে এই নতুন পর্যায়ের তফাতটা ধরিয়ে দেওয়া জরুরি। আমাদের দেশে ‘রাত দখল’-এর ডাক দিয়ে প্রতিবাদ প্রথম হয় নির্ভয়ার ঘটনার পর ৩১ ডিসেম্বর ২০১২-তে। সেই ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট’ ক্যাম্পেনের ডাক দেয় ‘সিটিজ়েন্স কালেকটিভ এগেনস্ট সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট’ নামে দিল্লির একটি গোষ্ঠী। তার পর তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যত্র। কলকাতাতেও ২০১৩-র গোটাটা জুড়ে রাস্তায় রাস্তায় প্রতি মাসে এক বার রাত দশটা নাগাদ মোমবাতি হাতে ১০০/২০০ মানুষ জড়ো হতেন ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট’-এর অংশ হয়ে। কিন্তু নানা কারণে শহরের উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত ইংরেজি-জানা মানুষের বাইরে সেই ক্যাম্পেন ছড়াতে পারেনি, যেটা এ বারে ঘটেছে শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। তবে এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন তুলছি।
১৪ অগস্ট এবং তার পরের দু’-একটা জমায়েতে কলকাতার পার্ক সার্কাস ও বেশ কিছু মফস্সলের সংখ্যালঘু মেয়েদের অংশগ্রহণ দেখা গিয়েছিল, যেটা পরের দিকে ফিকে হয়ে আসে। আমরা কি জানার চেষ্টা করব এটা কী কারণে ঘটল? তাঁদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ কি আন্দোলনের মধ্যে ‘মহালয়ার রাত দখল’, ‘দেবীপক্ষের ভোর দখল’ ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষঙ্গ এসে পড়া? হিন্দুত্ববাদী দলের শাঁখ বাজানোর কর্মসূচি থেকে নিজেদের দূরত্ব ঘোষণা করলেই কি দায় শেষ হয়, না কি যে মেয়েরা দূরে সরে যাচ্ছেন তাঁদের অস্বস্তির কারণগুলো বোঝার দায় নিতে হয় সংখ্যাগুরুকে?
আবার ফিরে যাওয়া যাক হুগলির ওই শিশুকন্যাটির মায়ের বক্তব্য উদ্ধৃত করার দ্বিতীয় কারণে। তাঁর মেয়ের ধর্ষক-খুনির ফাঁসির দাবি করেছেন তিনি। যে কোনও বয়সের যে কোনও মেয়ের ধর্ষণ-খুনের ক্ষেত্রে ওই একই শাস্তির দাবি আমি গ্রাম-শহরের বহু মেয়ের মুখে ইদানীং শুনছি। নানা ভাবে প্রান্তিক সেই সব মেয়ে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড অথবা জনতার হাতে অপরাধীদের তিলে-তিলে মৃত্যু চাইছেন। যে সাংঘাতিক হিংসাত্মক সময়ে আমরা বাস করছি, সেখানে ধর্ষকের মৃত্যুর দাবি এত জোরালো ভাবে মেয়েদের দিক থেকে উঠে আসছে কেন এটা নিয়ে আমাদের, নারী আন্দোলন ও মানবাধিকার আন্দোলন কর্মীদের বিশেষ করে ভাবা দরকার।
সামাজিক ভাবে উঠে আসা এই দাবির সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্র মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে নতুন আইন তৈরি করছে এবং এর ফলে আর্থ-সামাজিক ভাবে দুর্বল অপরাধীদেরই ফাঁসি হতে থাকবে, এটা আমরা জানি। কিন্তু কেন সমাজের পিছিয়ে-রাখা মেয়েদের কাছে আজ বিচার মানেই ফাঁসি অথবা তার থেকেও কাঙ্ক্ষিত গণপিটুনির মধ্যে দিয়ে ধর্ষকের মৃত্যু, এটা বোঝার জন্য সেই মেয়েদের কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে আমাদের শুনতে হবে। অনেক বছর না-শোনার ফলে আমরা কিছু বুলি কপচাতেই থাকছি— যেমন, ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড কোনও ভাবেই আমাদের সমাজে ‘রেপ কালচার’ বা ধর্ষণের সংস্কৃতিকে প্রতিরোধ করতে পারে না। প্রতি দিন যাঁদের সাংবিধানিক অধিকার খণ্ডিত হয়, বিচারব্যবস্থার নাগাল পাওয়া যাঁদের পক্ষে চাঁদে হাত বাড়ানোর সমতুল, কোন ব্যথার জায়গা থেকে তাঁরা ফাঁসি/গণপিটুনিকেই বেছে নিচ্ছেন সেটা কান পেতে শুনছি কই?
সম্প্রতি এক নাগরিক উদ্যোগের আহ্বানে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের যৌন হেনস্থা সংক্রান্ত একটা জনশুনানিতে উপস্থিত ছিলাম এক জেলা শহরে। সেখানে বিড়ি বাঁধেন অথবা দর্জির কাজ করেন এমন মেয়েরা এসেছিলেন। তাঁদের কথা শুনে বোঝা গেল কাজের জায়গায় যৌন হেনস্থার সে রকম কোনও ঘটনা না ঘটে থাকলেও প্রতি দিন মেয়ে/ট্রান্স-মেয়ে/সংখ্যালঘু মেয়ে হওয়ার জন্যে রাস্তাঘাটে-স্টেশনে-বর্ডারে এত ভাবে হেনস্থা হতে হয় যে জনশুনানি হবে শুনে সেই লাঞ্ছনা ও বিচার না পাওয়ার কথাগুলো ভাগ করে নেওয়ার জন্যেই তাঁরা এসেছেন— হয়তো কোনও সুরাহা হবে না এটা বুঝেও— কারণ সেগুলো বলার আর কোনও জায়গা নেই।
দু’-চার জন ধর্ষকের ফাঁসি হলে কোনও মেয়েরই নিরাপত্তার বোধ যে বাড়বে না, সেটা তাঁদের মতো দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মেয়েরা অনেকের থেকে ভাল জানেন। বিকল্প নিয়ে কথোপকথন শুরু করতে হলে আগে চাই গভীর শ্রবণ— সময় নিয়ে, হাতে আন্দোলনের অ্যাজেন্ডা লিস্ট না রেখে। মন দিয়ে শোনার মধ্যে দিয়ে যে সম্মানটুকু আমরা দিতে পারি, সেটুকু দিতে শুরু করলে হয়তো সংলাপ এগোবে, আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগবে।