গণনা কেন্দ্রে ভোটকর্মীরা। ছবি: পিটিআই।
লোকসভার ভোটগণনা শুরু হওয়ার বারো ঘণ্টা আগেই বিরোধী মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’র মধ্যে স্বরের ভিন্নতা দেখা গেল। এক দিকে আত্মবিশ্বাস, অন্য দিকে রক্ষণাত্মক মনোভাব। কংগ্রেস এবং ডিএমকে যেমন জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী মুখ তুলে ধরেছে, তেমনই সোমবার বিকেলে তৃণমূল এবং বিরোধী জোটের অন্য কিছু সূত্রে কিছুটা অভূতপূর্ব ভাবেই সম্ভাব্য পরাজয় ধরে নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মঙ্গলবার ‘আশানুরূপ ফলাফল’ না হলে, কী বিক্ষোভ কর্মসূচি নেওয়া হবে, তার একটি পরিকল্পনা ‘ইন্ডিয়া’র আগামী বৈঠকে তৈরি হবে, এটাই তৃণমূল-সহ বিরোধী সূত্রের একাংশের বক্তব্য।
বলা হচ্ছে, কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জোটের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মঙ্গলবার রাত বা বড়জোর বুধবার সকালের মধ্যে সবাইকে দিল্লিতে চলে আসতে বলা হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দিল্লি আসার ব্যাপারে ‘ইতিবাচক’ অবস্থান নিয়েছেন তা-ও জানিয়েছে ওই সূত্র। এর পর কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র কিছুটা ক্ষত মেরামতের ঢংয়ে উপরিউক্ত বার্তাটি পোস্ট করে লেখেন, “ফলাফলের পর ইন্ডিয়া ব্লক অবশ্যই বৈঠক করবে। কিন্তু এই বৈঠকের অন্য কোনও অর্থ খোঁজা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর এবং মিথ্যা।’’ তৃণমূল বা বিরোধী জোটের কোনও শরিক দল অবশ্য সরকারি ভাবে এর প্রতিক্রিয়ায় কোনও কথা বলেনি।
আজ সকালে রাজধানীতে ডিএমকে-র দলীয় অফিসে কে করুণানিধির জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে পূর্ব-নির্ধারিত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠানে ইন্ডিয়া মঞ্চের নেতারা একজোট হন। আলাদা করে বৈঠকের পরিসর সেখানে না থাকলেও কংগ্রেসের সনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, এনসি-র ফারুক আবদুল্লা, সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই-এর ডি রাজা, ডিএমকে-র টি আর বালুর মতো নেতারা এক মঞ্চে আসেন। তৃণমূলের কোনও শীর্ষ নেতা উপস্থিত না থাকলেও রাজ্যসভার সদস্য সাকেত গোখলে গিয়ে ফুল দিয়ে আসেন। ডিএমকে-র নেতা তথা তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন তাঁর এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, “সনিয়া গান্ধী, ফারুক আবদুল্লা, মাননীয় কমরেড-সহ ইন্ডিয়া ব্লকের নেতারা আজ নয়াদিল্লিতে কালাইগনারের জন্মশতবার্ষিকীতে উপস্থিত থেকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।… দেশের অনেক প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাঁর মুখ্য ভূমিকা দেশের রাজনৈতিক দিগন্ত তৈরিতে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। আগামী ৪ জুন আমাদের বিরোধী জোটের উদ্যাপনের জন্য আমরা প্রস্তুত, ইন্ডিয়া-র মানুষের জয় হবে।”
রাজনৈতিক সূত্রের মতে, স্ট্যালিনের এই ‘আত্মবিশ্বাস’ যে বিরোধী জোটের মূল সুর নয়, তা কিন্তু দু’দিন আগে দিল্লিতে ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বুথ ফেরত সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেই হওয়া ওই বৈঠকে রক্ষণাত্মক কৌশলের ব্যাপারে আলোচনা হয়, ফলাফল আশানুরূপ না হলে তার ব্যাখ্যা কী ভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরা হবে, তা নিয়েও কথা হয়। সূত্রের খবর, ওই বৈঠকের পর রাহুল গান্ধী সংবাদমাধ্যমকে ইন্ডিয়া মঞ্চের২৯৫টি আসন পাওয়ার কথা বলেন ঠিকই। কিন্তু বৈঠকের ভিতরে আলোচনা হয় যে, বিজেপি একা যদি ২৭০টির বেশি আসন পায় এবং ইন্ডিয়া যদি ২৩০টির আসনের কম পায়, তা হলে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হয়েছে কি না, এ প্রশ্ন তুলে সরব হতে হবে।
আজ দুপুরে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অন্য বিরোধী জোটের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এর পরই তৃণমূল সূত্রে প্রথম বিবৃতিটি উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, ‘‘ইন্ডিয়া জোটের সমস্ত শীর্ষ নেতাকে কংগ্রেস আগামিকাল রাতে, বা বড়জোর পরশু সকালের মধ্যে দিল্লি আসতে বলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এ ব্যাপারে ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছেন। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর এই বৈঠকটি হবে। যদি আসন সংখ্যা আশানুরূপ না হয় অথবা হিসাবমাফিক না আসে, তা হলে আন্দোলন/ সাংবাদিক সম্মেলন/ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার মতো অন্য উপায়গুলি নিয়ে আলোচনা হবে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হবে।”
সব মিলিয়ে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে বিরোধীদের আগাম ভূমিকা এবং বর্তমান চিন্তাভাবনা নিয়ে। রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, গত কাল পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোটের মধ্যে থাকবেনই—এমন কোনও স্পষ্ট বার্তা দেননি। তিনি বলেছিলেন, এ ব্যাপারে ‘অঙ্ক কষে’ দেখবেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন, ইন্ডিয়া জোটেরই শরিক ‘সিপিএমের হস্তক্ষেপ’ নিয়ে। তবে আজ তৃণমূল শীর্ষ সূত্রের কাছ থেকে পাওয়া বার্তায় এটা স্পষ্ট যে, শেষ মুহূর্তে বিরোধী জোটের প্রশ্নে ‘ইতিবাচক অবস্থান’ নেওয়া মমতা ফলাফল প্রকাশের পরেই দিল্লি আসছেন। রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রতি মমতার ‘অ্যালার্জি’ নতুন কোনও ঘটনা নয়। এই নিয়েই তৃণমূল দু’বছর সংসদে কংগ্রেসের সঙ্গে কক্ষ সমন্বয় যেটুকু যা করার করেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, কংগ্রেস যে ‘ইন্ডিয়া’র ২৯৫ আসন সংখ্যা বলছে, তার ভিত্তি কী? এই সংখ্যা ‘ইন্ডিয়া’কে পেতে হলে কংগ্রেসকে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, তেলঙ্গানা, কর্নাটকের মতো রাজ্যগুলিতে আশাতীত ভাল ফল করতে হবে, যা বুথ ফেরত সমীক্ষাই শুধু নয়, সাধারণ সমীক্ষাতেও কঠিন দেখাচ্ছে। রাজনৈতিক সূত্রের মতে, কংগ্রেস নেতৃত্ব এক দিকে এই আত্মবিশ্বাসের ছবিটি সামনে আনছেন। অন্য দিকে আশানুরূপ ফলাফল না হলে, নির্বাচন কমিশন, ইভিএম কারচুপি, বুথ দখলের মতো অভিযোগকেও সাফাই হিসাবে ভেবে রাখছেন। কারণ, লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের পরে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দায় কংগ্রেসেরও রয়েছে।