ভারত-মায়ানমার বন্ধুত্বদ্বারের কাছে ধ্বংশস্তূপ। ছবিঃ রাজীবাক্ষ রক্ষিত।
দুঃখিত। গেরস্থালির এ ধ্বংসাবশেষ বর্ণনা করার মতো বিশেষণ পাচ্ছি না।
ক্ষমাপ্রার্থী তাদের কাছে, যাদের দগ্ধ বইখাতা পায়ে মাড়িয়ে এলাম অবলীলায়।
মৌন, কারণ ওদের ধূসর শৈশবের গল্প কোনও মতে টুকে নিয়েই আমার দায় সারা! বড়জোর বাড়ানো হাতে একটা লজেন্স।
ব্যস! গাড়ি হাঁকিয়ে একছুট শহুরে আরামে।
গন্তব্য ছিল, মায়ানমার সীমান্তের মোরে। মণিপুরের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র। ইম্ফল থেকে পাল্লেল আসার পরেই কুখ্যাত ‘বাফার জ়োন’। ২০০ মিটার এলাকা ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’। ও পার থেকে শুরু টেংনোওপাল জেলা। যার মালিকানা এখন কুকিদের হাতে। পৌঁছনোর বিস্তর হ্যাপার কথা থাক। শহরে ঢুকতেই থানার সামনে মেইতেই রাজার বিরাট মূর্তি তরবারি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে। ১০০ মিটার দূরেই ইংরেজ-কুকি লড়াইয়ের নেতা চুংখোকাই ডংজেলের রণংদেহি মূর্তিও। থানার সামনে বলেই হয়তো মেইতেই রাজার এখনও গর্দান যায়নি।
কুকি ছাত্রনেতা সসান হমার শোনান সোনালি দিনের গল্প। তখন রমরমা মোরের। বৈধ ও অবৈধ বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র মোরে। রাজ্যে উড়তে থাকা টাকার উৎস মোরে। ও-পারে তামুতে সপ্তাহান্তে পার্টি বাঁধা। কিন্তু ভারত-মায়ানমার বন্ধুত্বদ্বার (ফ্রেন্ডশিপ গেট) কোভিডের পরে আর খোলেনি। মেনাল নদীর উপরে ১ নম্বর বন্ধুত্বদ্বারে জমাট আগাছা তার সাক্ষী। অবশ্য এখানে সীমান্তবেড়া মাত্র ১০ কিলোমিটার। বাকি অংশ থেকে মোরে হয়ে বিরাটকায় সিম (যোংচাক), আনাজ, বিদেশি সিগারেট, খাবার, বৈদ্যুতিক সামগ্রী থেকে শুরু করে মাদক, সুপুরি, সোনা, অস্ত্রশস্ত্র— সবই অবাধে ঢুকত। মোরে হয়ে ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে তৈরি হয়েছে মায়ানমারের ভিতর দিয়ে তাইল্যান্ড পর্যন্ত। সাম্প্রতিক সংঘর্ষের জেরে কেন্দ্র দুই পারে অবাধ গতিবিধির নিয়ম (এফএমআর) বন্ধ করায় ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির সাফল্যের এত বড় বিজ্ঞাপনের ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
শহর ছেড়ে এগোতেই রাস্তার ডাইনে ভারত, বাঁয়ে বর্মি সেগুনগাছের সারি। তামুতেও বর্মি সেনা ও জনতা-বাহিনীর লড়াই চলছে। তাই অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন সীমান্তের পাশে।
এই শহরে কুকি-হমার তো বটেই, অনেক মেইতেই, পাঙ্গাল মুসলিম, তামিল, বিহারি, পঞ্জাবির বাস। ১৯৬৪ সালে বর্মা থেকে আসা তামিলদের একটি অংশ মোরেতে বসবাস শুরু করেছিলেন। এলাকায় রয়েছে বিরাট তামিল মন্দির, গ্রন্থাগার, অতিথিশালা। আজাদ হিন্দ বাহিনীর স্মৃতিতে ১৯৬৯ সালে এখানে গড়ে ওঠে নেতাজি মেমোরিয়াল স্কুল। সেখানে ১৯৮০ সাল থেকে পড়ানো প্রধান শিক্ষক তথা তামিল সঙ্গমের সাধারণ সম্পাদক মানিয়ান বালা জানালেন, ৫৭৬ জন শিক্ষার্থীর স্কুলে সংঘর্ষের পরে এখন ১৬০ জন ছাত্রছাত্রী আসছে। সাড়ে তিন হাজার তামিলের মধ্যে দু’হাজার চেন্নাই ফিরে গিয়েছেন। কারণ, রোজগার বন্ধ। সব বিহারি ক্ষৌরকার ও চর্মকার পাততাড়ি গুটিয়েছেন। হমার জানান, দায়ে পড়ে কুকি যুবকদের অনেকে এখন শুরু করেছেন চুল কাটা, জুতো সারানোর ‘স্টার্ট আপ’।
এমনিতে সব মেইতেই বাড়িই ভাঙা। কিন্তু ভারত-মায়ানমার দুই নম্বর দরজা থেকে তামিল পাড়া পর্যন্ত দৃশ্য অবর্ণনীয়। দুই পাশে শুধুই ভাঙা কাঠামো, পোড়া বাড়ি, পোড়া গাড়ি। জীবনের সব সঞ্চয় জড়ো করে তৈরি বাহারি বাড়ির বৈঠকখানা থেকে উপরে ওঠার সোনালি রেলিংটা আধখানা হয়ে ঝুলে রয়েছে শৌখিনতার সাক্ষ্য দিতে। জনরোষ থেকে রক্ষা পাননি আরাধ্য দেবতাও। পোড়া গাড়ির পিছনে মন্দিরটার কাঠামোটুকুই খালি টিকে। নিরপেক্ষতা প্রমাণে ঘরের দরজায় বড় করে ‘তামিল হাউস’ লিখেও লাভ হয়নি। পাশের বাড়ির আগুন তো ইংরেজি পড়তে শেখেনি!
পোড়া সিঁড়িতে পা রেখেই এক বাড়ির উপরতলায় উঠলাম। যত দূর চোখ যায়, শুধুই ধ্বংসচিহ্ন। নামার সময় পোড়া ছাই থেকে মুখ বার করা পুতুল আর কাঠকয়লায় উঁকি মারা পাঠ্যবইয়ের স্তূপে পা দিতেই হল।