প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে চন্দ্রবাবু নায়ডু এবং পবন কল্যাণ। —ফাইল চিত্র ।
জোটের আমি জোটের তুমি জোট দিয়ে যায় চেনা!
অন্ধ্রপ্রদেশে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মূল চরিত্র ছিল একটাই— জোট। মুখ্যমন্ত্রী জগনমোহন রেড্ডির দল ওয়াইএসআর কংগ্রেস (ওয়াইএসআরসিপি)-কে হারাতে বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধেছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডুর দল তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)। সেই বিজেপির সঙ্গে, অন্ধ্রের বিশেষ মর্যাদার দাবিতে ২০১৮ সালে যাদের হাত ছেড়েছিলেন চন্দ্রবাবু। জোট (রাজ) নীতিতে ‘বন্ধু’ হিসাবে টিডিপির পাশে আগে থেকেই ছিল অভিনেতা-রাজনীতিক পবন কল্যাণের দল জনসেনা পার্টি (জেএনপি)। উদ্দেশ্য ছিল ‘জোট’ দিয়ে ভোট জেতা। যদিও মূল লড়াই সীমাবদ্ধ ছিল জগন এবং চন্দ্রবাবুর মধ্যেই। জোট করে জয়ের রাস্তা যে এত সহজে মিলবে, তা সম্ভবত ভাবেননি চন্দ্রবাবু নিজেও। কিন্তু ফলপ্রকাশের পর দেখা গেল, টিডিপির ধাক্কায় ধরাশায়ী অবস্থা ওয়াইএসআরসিপি-র। চন্দ্রবাবুর দল একাই যে সংখ্যক আসনে জিতেছে, তার ধারে কাছেও নেই জগনের দল। অন্ধ্রপ্রদেশের লোকসভা নির্বাচনে চন্দ্রবাবুর দল পেয়েছে ১৬টি আসন। জোট সঙ্গী বিজেপি এবং জেএনপির দখলে যথাক্রমে ৩টি এবং ২টি করে আসন। অন্য দিকে, মুখ্যমন্ত্রী জগনের দল মাত্র ৪টি আসনে জিতেছে। বিধানসভা নির্বাচনেও পর্যদুস্ত হয়েছে ওয়াইএসআরসিপি।
অন্ধ্রপ্রদেশের ২৫টি লোকসভা আসনের সঙ্গেই ১৭৫টি বিধানসভায় এক দফায় ভোট হয়েছিল গত ১৩ মে। সেখানে ওয়াইএসআরসিপি-কে হারাতে বিজেপি এবং জেএনপির সঙ্গে জোট করেছিল চন্দ্রবাবুর টিডিপি। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটেও বিজেপির সঙ্গে জোটে ছিলেন চন্দ্রবাবু। কিন্তু অন্ধ্রের বিশেষ মর্যাদার দাবিতে ২০১৮ সালে এনডিএ ছেড়েছিল টিডিপি। ২০১৯-এর লোকসভা এবং অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভা ভোটে একাই লড়েছিল তারা। সেই ভোটে জগনমোহনের ওয়াইএসআরসিপি-র কাছে হেরে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি হারিয়েছিলেন চন্দ্রবাবু। ছ’বছর পরে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে আবার এনডিএ-তে প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল তাঁর। প্রতিটি আসনেই প্রার্থী দিয়েছিল ওয়াইএসআরসিপি। জোটের বুনিয়াদি নিয়ম মেনে আসন ভাগাভাগি হয়েছিল টিডিপি, জেএনপি এবং বিজেপির মধ্যে। টিডিপি ১৭টি, জেএনপি দু’টি এবং বিজেপি প্রার্থী দিয়েছিল ছ’টি কেন্দ্রে।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে তেলঙ্গানা রাজ্য গড়েছিল প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সরকার। তবে ভোট হয়েছিল একসঙ্গেই— ৪২টি লোকসভা আসনে। ত্রিমুখী ল়ড়াইয়ে টিডিপি এবং ওয়াইএসআরসিপি-র সঙ্গে ছিল কলভাকুন্তলা চন্দ্রশেখর রাও (‘কেসিআর’ নামেই বেশি পরিচিত)-এর দল ভারত রাষ্ট্র সমিতি বা বিআরএস (আগে নাম ছিল তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি বা টিআরএস)-ও। তবে চন্দ্রবাবুর দলের সমর্থনেই বেশি ভোট পড়েছিল লোকসভায়। ৪২টি আসনের মধ্যে টিডিপি পেয়েছিল ১৬টি। অন্য দিকে, জগনের দল ন’টি এবং বিআরএস ১১টি আসন পেয়েছিল। দুই ক্ষেত্রেই তলানিতে ছিল বিজেপি এবং কংগ্রেস। এর পরেই অন্ধ্রের রাজনীতি থেকে বিদায় নেন কেসিআর। চলে যান তেলঙ্গানায়। সে বছরই তেলঙ্গানায় সরকার গড়ে মুখ্যমন্ত্রীও হন তিনি। খণ্ডিত অন্ধ্রের লোকসভার আসন ৪২ থেকে কমে হয় ২৫। বাকি ১৭টি আসন যায় তেলঙ্গানায়।
২০১৯ সালে হিসাব বদলে যায়। অন্ধ্রের বিধানসভা নির্বাচনে গদি উল্টোয় চন্দ্রবাবুর। সরকার গড়ে ওয়াইএসআরসিপি। লোকসভা নির্বাচনেও ২৫টি আসনের মধ্যে তারাই জিতেছিল ২২টি আসন। টিডিপি জিতেছিল মাত্র তিনটি। বিজেপি, কংগ্রেস এবং জেএনপি একটি আসনেও জেতেনি। তবে এ বারের লোকসভা নির্বাচনে টিডিপি-বিজেপি-জেএনপির জোট মুখ্যমন্ত্রী জগনকে বেগ দিতে পারে বলেই ভোটপণ্ডিতদের একাংশের ধারণা। অনেকের ধারণা ছিল, জোটশক্তির কাছে ওয়াইএসআরসিপি কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়লেও শেষ হাসি হাসবেন জগনই। তবে ভোটপণ্ডিতদের সেই অনুমান মিলল না। টিডিপি ঝড়ে খড়কুটোর মতো উড়ে গেল ওয়াইএসআরসিপি। পাঁচ বছর পর আবারও অন্ধ্রপ্রদেশের কুর্সিতে ফেরা নিশ্চিত করলেন চন্দ্রবাবু।
২০১৯ সালে খণ্ডিত অন্ধ্র থেকে কোনও লোকসভা এমনকি, বিধানসভা আসনেও জিততে পারেনি কংগ্রেস। তাই এ বার ‘জোট’কে বেছে নিয়েছিল তারাও। তবে কোনও দলের সঙ্গে নয়, ব্যক্তির সঙ্গে। অখণ্ড অন্ধ্রের প্রয়াত কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী রাজশেখর রেড্ডির কন্যা তথা বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী জগনের বোন শর্মিলাকে প্রদেশ কংগ্রেস সভানেত্রীর দায়িত্ব দিয়ে ‘শূন্য অঙ্ক’ শেষের লড়াই শুরু করেছিল কংগ্রেস। গত জানুয়ারিতে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে এবং রাহুল গান্ধীর উপস্থিতিতে ‘হাত’ শিবিরে শামিল হওয়ার পরেই অন্ধ্রপ্রদেশ কংগ্রেস সভানেত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন শর্মিলা। রেড্ডি পরিবারের ‘গড়’ হিসাবে পরিচিত কড়াপ্পা লোকসভায় প্রার্থী করা হয়েছিল তাঁকে। শর্মিলার বাবা রাজশেখর ওই আসন থেকে চার বার লোকসভায় জিতেছিলেন। দাদা জগন দু’বার। সেই সূত্র কাজে লাগিয়েই কড়াপ্পা আসন জিততে কংগ্রেস এ বার শর্মিলাকে ‘তুরুপের তাস’ করেছিল। অন্ধ্রপ্রদেশের লোকসভা নির্বাচনে সেই সিদ্ধান্ত শূন্যের অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিতে পারল না কংগ্রেসকে। কড়াপ্পা থেকে শর্মিলা হেরেছেন।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধলেও পদ্মশিবিরকে নিয়ে চিন্তা কম ছিল না টিডিপি-র। অন্ধ্রের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ ইসলাম এবং ২ শতাংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে যথেষ্ট সমর্থন পেয়েই জগনের দল ওয়াইএসআরসিপি অন্ধ্রে ক্ষমতায় এসেছে। তাই বিজেপির ‘সংখ্যালঘুবিরোধী’ মন্তব্য জোটের উদ্দেশ্যে ‘জট’ ফেলতে পারে বলে মনে করেছিল টিডিপি। তবে তা হয়নি। উল্টে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে স্কিল ডেভেলপমেন্ট দুর্নীতি মামলায় চন্দ্রবাবুর গ্রেফতারি যে অন্ধ্রের জনগণ ভাল ভাবে নেননি, তা-ও স্পষ্ট হয়েছে ফলাফল থেকে।
ওয়াইএসআরসিপি এবং টিডিপি— উভয়েই এ বার ‘পাখির চোখ’ করেছিল কাপু সম্প্রদায়ের ভোটকে। অন্ধ্রে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ কাপু সম্প্রদায়ভুক্ত, যার অধিকাংশই পূর্ব ও পশ্চিম গোদাবরী জেলা এবং উত্তর অন্ধ্রে বসবাস করে। কাপু সম্প্রদায়ের ভোট নিজেদের দিকে টানতে টিডিপি-বিজেপি-জেসিপি জোটের পাল্লা ভারী ছিল। কারণ, জেএনপি প্রধান তথা অভিনেতা পবন নিজেও কাপু সম্প্রদায়ভুক্ত। এ ছাড়াও চন্দ্রবাবু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কাপু সম্প্রদায়কে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে-পড়া শ্রেণি (ইডব্লুএস)-র আওতায় যে ৫ শতাংশ সংরক্ষণ দিয়েছিলেন, জগন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তা বাতিল করে দেন। জগনের যুক্তি ছিল, ইডব্লিউএস সংরক্ষণের মূল ভিত্তি কোনও ব্যক্তির জাত নয়, অর্থনৈতিক অবস্থা। তাই কাপুদের ভোট এ বার জগনের পক্ষে পড়বে না বলেই মনে করেছিলেন অনেকে।
পাশাপাশি, অন্ধ্রের নির্বাচনে এ বার অন্যতম ‘ফ্যাক্টর’ ছিল বেকারত্ব। ‘পিরিয়োডিক লেবার ফোর্স সার্ভে’ (পিএলএফএস)-র সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে বেকারত্বের নিরিখে দেশের বাকি রাজ্যগুলির মধ্যে অন্ধ্র ছিল তৃতীয় স্থানে। তাই এ বার রাজ্যের যুব সম্প্রদায়ের ভোট সরকারের বিরুদ্ধে পড়তে পারে বলেও অনেকে মনে করেছিলেন। ফলাফল দেখে পরিষ্কার যে, ভোট এবার জগনের বিরুদ্ধেই পড়েছে। তবে শুধু যুবরা নন, ওয়াইএসআরসিপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন অন্ধ্রের বেশিরভাগ মানুষই।