প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র ।
মোদীকরণ!
‘মেরুকরণ’ বা অন্য কোনও রাজনীতিতে নয়, ‘মোদীকরণ’ নীতিতেই ২০১৪ এবং ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সাফল্য এসেছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর গুজরাতে। ২০২৪-এও তার অন্যথা হল না। তবে গত দু’টি লোকসভা নির্বাচনের মতো ২০২৪-এর নির্বাচনে গুজরাত বিরোধীশূন্য নয়। ২৬ লোকসভা আসনের গুজরাতে বনাসকাঁটা আসনে জয় পেয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী গেনিবেন নাগাজি ঠাকোর।
বনাসকাঁটা বিজেপির শক্ত ঘাঁটি হিসাবেই পরিচিত ছিল। ২০১৯ সালের নির্বাচনে, বিজেপির পর্বতভাই পটেল কংগ্রেসের প্রার্থী, পার্থী ভাটোলের চেয়ে তিন লক্ষের বেশি আসনে জিতেছিল। ২০১৪ সালেও ওই আসনে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। তবে ঠাকোর সম্প্রদায় অধ্যুষিত ওই আসনে এবার ঠাকোর সম্প্রদায়ের প্রার্থী গেনিবেনকে প্রার্থী করেছিল কংগ্রেস। রাজনৈতির বিশেষজ্ঞদের মতে, কংগ্রেসের ওই একটি সিদ্ধান্তই খেলা ঘুরিয়ে দিয়েছে। আটকে দিয়েছে বিজেপির ২৬-এ ২৬-এর হ্যাটট্রিকের রেকর্ড।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে ২৬ আসনের গুজরাতে ১৫টি আসন জিতেছিল বিজেপি। বাকি ১১টি জিতেছিল কংগ্রেস। সেই শেষ বার। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ‘মোদীঝড়ে’ উড়ে গিয়েছিল কংগ্রেস। ২৬-এ ২৬ এসেছিল বিজেপির ঘরেই। প্রধানমন্ত্রী মোদীর আপন ‘দেশে’ লোকসভা নির্বাচনে গুরুত্ব হারিয়েছিল কংগ্রেস। ২০১৯ সালেও হিসাব এক। দু’বারই বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ছিল ৬০ শতাংশের উপরে। গত দু’টি লোকসভা নির্বাচনেই দেশ জুড়ে মোদীর নামে ভোট পড়ার অনেক ‘ইস্যু’ কাজ করলেও গুজরাতে ‘ফ্যাক্টর’ একটাই— খোদ মোদী। ২৬-এ ২৬ না হলেও সেই ফ্যাক্টরেই জয় এল ২০২৪-এও। হিসাব মেনেই গান্ধীনগর থেকে সাত লক্ষের বেশি ভোটে জিতেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। পোরবন্দর থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মনসুখ মান্ডবীয় জিতেছেন। যদিও এ বার গুজরাতে লড়াই ছিল ২৫টি আসনে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সুরাত আসনে জয় আগে থেকেই নিশ্চিত ছিল বিজেপি প্রার্থী মুকেশ দালালের।
গত ১০ বছর ধরে দেশের ক্ষমতায় থাকা বিজেপির ‘আদিভূমি’ গুজরাত। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ২০০১ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত টানা সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মোদী। দিল্লি গিয়েও গুজরাতের সঙ্গে তাঁর ‘একাত্মতাবোধ’ কমেনি। রাজ্যের রাজনৈতিক মহলের একাংশ মেনে নেয়, ২০১৪ সালের পর থেকে বিধানসভা হোক বা লোকসভা, গুজরাতে বিপুল জয় পাওয়ার বিষয়ে মোদীকেই এগিয়ে রাখে পদ্মশিবির। ভোটও পড়ে মোদীর নামেই। ২০২৪-এর নির্বাচনের আগেও গুজরাত বিজেপির নেতা-কর্মীদের কাছে সেই লক্ষ্যই বেঁধে দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বার বার বলা হয়েছিল, ২০২৪ সালে ফের ‘ভূমিপুত্র’ মোদীকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে হলে পথ দেখাতে হবে গুজরাতকেই। জপতে হবে ‘মোদী-মন্ত্র’। কর্মীদের চাঙ্গা করা থেকে ভোটারদের আর্জি জানানো— সবেতেই এই ছিল বিজেপির মূল স্লোগান।
২০১৪ সালে মোদীকে জেতানোর পাশাপাশি কংগ্রেসকে গদিচ্যুত করার ভোটও পড়েছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে বিজেপিতে ভোট পড়েছিল মোদীকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে রেখে দেওয়ার পক্ষে। কারণ, মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই পরিকাঠামোগত উন্নতি দেখেছে গুজরাত। বৃহৎ শিল্প ও নগরায়নের প্রসারে ‘শ্রীবৃদ্ধি’ হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বিরোধিতা থাকলেও তা সঠিক সময়ে সামলে নিয়েছিল পদ্মশিবির। তবে মোদীরাজ্যে ২০২৪ সালের ভোটের অঙ্কের হিসাব ছিল আলাদা। এই লোকসভা ভোটে গুজরাতে বিজেপির চ্যালেঞ্জ ছিল বিজেপিই। আবার ২৬-এ ২৬ করার লড়াই। লড়াই ভোটের হার বৃদ্ধিরও। তবে অঙ্ক পুরোপুরি মেলাতে পারল না বিজেপি। একটি আসনে জয় রয়ে গেল অধরা। অন্য দিকে, পর পর দু’টি লোকসভা আসনে কোনও আসন না পাওয়ার পর এক দশক পর ২০২৪-এর লোকসভায় আবার খাতা খুলল কংগ্রেস।
তবে পদ্মবনে এ বার ‘কাঁটা’ও ছিল বিস্তর। গুজরাতে ১৯৯৫ থেকে ক্ষমতায় বিজেপি। তবে ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সে রাজ্যে তাদের সিংহাসন খানিক টলমল করেছিল। ১৮২ আসনের বিধানসভায় ২০১২ সালে বিজেপি পেয়েছিল ১১৫টি আসন। ২০১৭ সালে সেই সংখ্যা নেমে এসেছিল ৯৯-এ। আসন বেড়েছিল কংগ্রেসের। তবে আসন কমলেও বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার বেড়েছিল। ২০১২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তারা পেয়েছিল ৪৭.৮৫ শতাংশ ভোট। ২০১৭ সালে ৪৯.০৫ শতাংশ। আসনের নিরিখে ১৯৯৫ সালের পর থেকে ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনেই গুজরাতে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে বিজেপি। যার কারণ হিসেবে অনেকে গুজরাতের ‘মোদী-হীন’ হওয়ার কথা বলেছিলেন। আবার অনেকে দাবি করেছিলেন, আসল কারণ ‘পাটিদার আন্দোলন’। যার প্রচ্ছন্ন প্রভাব দেখা গিয়েছিল ২০১৯-এর লোকসভা ভোটেও। বিজেপি রাজ্যের ২৬টি আসন জিতলেও পাটিদার প্রভাবযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ আসনে তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার কমেছিল।
২০১৯ সালে দ্বিতীয় বার দেশের ক্ষমতায় এসেই পাটিদারদের মন জয়ে নেমেছিল মোদী-শাহ জুটি। আর্থিক ভাবে অনগ্রসরদের জন্য শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের পক্ষে সংসদে বিল পাশ করে সরকার। বিষয়টি আদালতে গেলে সুপ্রিম কোর্ট চলতি বছরে সরকারের ওই সিদ্ধান্তে সবুজ সঙ্কেত দেয়। ফলে পাটিদার আন্দোলন অনেকটাই প্রশমিত হয়েছিল। পাটিদার সংরক্ষণের দাবিতে যাঁর নেতৃত্বে ২০১৭ সালে বিজেপি-বিরোধী হাওয়া তৈরি হয়েছিল, সেই আন্দোলনের নেতা হার্দিক পটেল এখন নিজেই বিজেপি বিধায়ক।
২০১৭-এর বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে সবচেয়ে বেশি বেগ দিয়েছিল যে পাটিদার সম্প্রদায়, পাঁচ বছর পরে ২০২২-এর নির্বাচনে তারাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিজেপির জয়রথের অন্যতম চাকা। ২০২২ সালের বিধানসভায় গুজরাতে ১৫৬টি আসন পেয়েছিল বিজেপি। তলানিতে পৌঁছেছিল বিরোধী কংগ্রেসের আসন, মোটে ১৭টি! গুজরাতের রাজনীতির ইতিহাসে ২০২২ সালের বিধানসভা নির্বাচনেই সবচেয়ে বেশি আসন জিতেছিল বিজেপি। সেখানে থেকেই ২০২৪ নিয়ে আত্মবিশ্বাস বেড়েছিল বিজেপির। ২০২২-এর বিধানসভা নির্বাচনের স্কোরবোর্ডই ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জন্য বড় ভিত তৈরি করে দিয়েছিল।
তবে গুজরাতে বিজেপি ফাঁপরে পড়ে লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে আগে। জাতি অবমাননার অভিযোগ ওঠে রাজকোটের বিজেপি প্রার্থী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পুরুষোত্তম রূপালার বিরুদ্ধে। রূপালা তাঁর নির্বাচনকেন্দ্রে দলিতদের একটি সভায় বলে বসেন, ‘‘বিদেশি মোগলেরা আমাদের উপর রাজত্ব করেছে। ব্রিটিশরাও করেছে। ওরা আমাদের অত্যাচার করতে ছাড়েনি। কিন্তু রাজপুত মহারাজারা ওদের প্রণাম করতেন এবং ‘রুটি ও বেটি’-র সওদা করতেন। আমাদের রুখী (গুজরাটের দলিত) সম্প্রদায় কিন্তু তাদের ধর্ম পরিবর্তন করেনি বা ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্পর্কও করেনি।’’
ঝড় ওঠে গুজরাতের রাজপুত-ক্ষত্রিয় সমাজে। পাটিদার সম্প্রদায়ভুক্ত রূপালার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে রাজপুত সংগঠন করণী সেনা। রূপালার মন্তব্যের পরে বিজেপি থেকে পদত্যাগ করেন ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের নেতা রাজ শেখাওয়াত। বেগতিক বুঝে রূপালা একাধিক বার ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু মানতে নারাজ রাজ্যের রাজপুত নেতারা। রূপালার প্রার্থিপদ বাতিল না করলে চিতোরের রানি পদ্মাবতী এবং তাঁর সহচরীদের অনুকরণে রাজপুত-ক্ষত্রিয় সমাজের পাঁচ নারী তাঁদের আত্মসম্মান রক্ষার জন্য ‘জহর’ (আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা) ব্রত পালন করার হুমকি দেন। শুধু গুজরাত নয়, রাজস্থান, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তরপ্রদেশেও বিভিন্ন রাজপুত-ক্ষত্রিয় সংগঠন বিজেপি-বিরোধী প্রচারে নামে। যদিও শেষ পর্যন্ত রূপালার প্রার্থিপদ বাতিল করেনি বিজেপি। বরং তাঁর হয়ে প্রচারে নেমেছিলেন দলের অনেক বর্ষীয়ান নেতা। তবে পুরো বিষয়টি ঘিরে গুজরাত বিজেপির অন্দরে দ্বিমত তৈরি হয়েছিল। আত্মবিশ্বাসী অংশ মনে করেছিলেন, এই বিক্ষোভ লোকসভা নির্বাচনে গুজরাত জয়ের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। বরং এই আন্দোলন পাটিদার, তফসিলি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি এবং প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের মধ্যে বিজেপির অবস্থান আরও ‘সুসংহত’ করবে। অন্য অংশের অভিমত ছিল, রাজপুত-ক্ষত্রিয়দের রোষে পড়ে অন্তত পাঁচটি আসনে হারতে পারে বিজেপি। তবে তেমনটা হয়নি।
লোকসভা নির্বাচনে বিভিন্ন আসনে প্রার্থী বাছাই নিয়েও দলেরই একাংশের ক্ষোভের মুখে পড়েছিল বিজেপি। প্রার্থিতালিকা প্রকাশের পর থেকে দু’জন বিজেপি প্রার্থী রঞ্জনবেন ভট্ট এবং ভিখাজি ঠাকোর মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। এর মধ্যে রঞ্জনবেন আবার বডোদরার দু’বারের সাংসদ। তাঁর নাম প্রার্থী হিসাবে ঘোষণার পর থেকেই দলের একাংশের সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে বিভিন্ন এলাকায় পোস্টার পড়েছিল। প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন বিজেপির মহিলা মোর্চার জাতীয় ভাইস-চেয়ারম্যান জ্যোতি পাণ্ড্য। যদিও তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। ক্ষোভের মুখে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন রঞ্জনবেন। তাঁর জায়গায় বিজেপি প্রার্থী করে বডোদরা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন স্কুল বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান তথা প্রাক্তন ছাত্রনেতা হেমাঙ্গ জোশীকে।
রঞ্জনবেনের মনোনয়ন প্রত্যাহারের দিনেই মনোনয়ন তুলে নেন বিজেপির সবরকাঁটা কেন্দ্রের প্রার্থী ভিখাজি। পদবি নিয়ে বিতর্কের কারণে তিনি সরে আসেন। তাঁর জায়গায় প্রার্থী করা হয় সরকারি স্কুলশিক্ষিকা তথা প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক মহেন্দ্র বরাইয়ার স্ত্রী শোভনা বরাইয়াকে।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য এবং পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মনসুখ মান্ডবীয়কে পোরবন্দর লোকসভা আসনে প্রার্থী করার বিরোধিতা করে এলাকায় পোস্টার পড়ে। লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে আগে এই বিষয়গুলি বিজেপির গলায় ‘কাঁটা’ হয়ে ফুটেছিল। ক্ষত মেরামতের জন্য বিশেষ সময় পায়নি পদ্মশিবির। সেই সব ‘কাঁটা’ ফেলতে সক্ষম হলেও বনাস‘কাঁটা’য় পা কাটল বিজেপির।