ত্র্যহস্পর্শ!
তিন এক্কে তিন! বাংলার রাজনীতিতে সিংহ পরিবার এক বিরল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। তাদের তিনটি প্রজন্ম তিনটি আলাদা আলাদা দলের হয়ে বিধায়ক হয়েছেন একই কেন্দ্র থেকে। কেন্দ্রের নাম ভাটপাড়া। ১৯৭১, ১৯৭২ এবং ১৯৮৭ সালে সেখান থেকে কংগ্রেসের বিধায়ক হন সত্যনারায়ণ সিংহ। তাঁর পুত্র অর্জুন ভাটপাড়া বিধানসভায় ২০০১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত চার বার জিতেছেন তৃণমূলের টিকিটে। অর্জুনের পুত্র পবন দু’বার জিতেছেন বিজেপির টিকিটে। এখনও ভাটপাড়ার বিধায়ক পবনই। তিনি আবার প্রথম জিতেছিলেন ২০১৯ সালের উপনির্বাচনে। ঘটনাচক্রে, যে উপনির্বাচন হয়েছিল তাঁর বাবা অর্জুন লোকসভায় জেতায় ভাটপাড়া খালি হয়ে যাওয়ায়।
পবন যখন পুত্র
অর্জুন তৃণমূলে ফিরলেও পুত্র পবন দল বদলাননি। থেকে যান বিজেপিতেই। শুভেন্দু অধিকারীর স্নেহের পাত্র পবন বাবা দলবদল করায় মোটেই খুশি হননি। বহু দিন পিতা-পুত্রে বাক্যালাপ বন্ধ ছিল। পুত্রই কথা বলা বন্ধ করেছিলেন। তবে এখন আবার আমে-দুধে মিশে গিয়েছে। অর্জুন বিজেপিতে ফেরার পরে পুত্র পবনের সঙ্গে তাঁর ছবি ছড়িয়েছে। ক্যাপশন: ‘তোর টিমে, তোর পাশে’।
তড়িৎবরণ মুগ্ধকরণ
দীর্ঘ দিন ভাটপাড়া পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন অর্জুন। পাশাপাশি বিধায়ক ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সামলেছেন। ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূলের টিকিটে লড়ে সিপিএমের তড়িৎবরণ তোপদারের কাছে হেরে যান। তবে তড়িৎ-অর্জুন ব্যক্তিগত সম্পর্ক বরাবরই ভাল। বাম জমানায় বার বার বিধানসভা ভোটে অর্জুনের জেতার কারণ নিয়ে উত্তর ২৪ পরগনা সিপিএমে জল্পনা ছিল। যাক সে কথা! তবে এ বারেও প্রার্থী হওয়ার পর তড়িৎসদনে গিয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে এসেছেন অর্জুন।
মুকুল নামের মহীরুহ
তৃণমূলে থাকাকালীন উত্তর ২৪ পরগনার রাজনীতিতে মুকুল রায়ের সঙ্গে অর্জুনের অহি-নকুল সম্পর্ক ছিল। সেই মুকুল বিজেপিতে যাওয়ার দু’বছরের মধ্যেই অর্জুন তাঁর অনুসারী হন। ২০১৯ সালের সেই মুকুল আর নেই। নামেই তিনি বিজেপির বিধায়ক। তিনি এখন অসুস্থ। অশক্ত। অসংলগ্ন। রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। কিন্তু এ বারও প্রার্থী হওয়ার পর মুকুলের বাড়ি গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে এসেছেন অর্জুন।
দোলে দোদুল দোলে
অর্জুন এক আশ্চর্য রাজনৈতিক দোলনায় দোলেন। দুলতেই থাকেন। এক বার এ দিকে, তো অন্য বার ও দিকে। ২০১৯ সালে তাঁর বদলে দীনেশ ত্রিবেদীকে তৃণমূল ব্যারাকপুরে টিকিট দেওয়ায় পট কর বিজেপিতে চলে গিয়েছিলেন। বিজেপি তাঁকে মনোনয়নও দেয়। তিনি জেতেন। এখনও আঙুলে তুড়ি দিয়ে গর্ব করে বলেন, ‘‘আঠাশ দিনে রুলিং পার্টিকে হারিয়েছিলাম!’’ কিন্তু ২০২২ সালে ক্যামাক স্ট্রিটে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসে গিয়ে সেই রুলিং পার্টিতেই ফিরলেন। ২০২৪ সালে আবার ব্যারাকপুরের টিকিট না-পেয়ে ঝপ করে বিজেপিতে ফেরত। কীমাশ্চর্যম, তৃণমূল ছেড়ে আসা অর্জুনকে এ বারেও টিকিট দিয়েছে বিজেপি!
চটচটে
অর্জুনের রাজনীতি চটকল ঘিরে। শিল্পাঞ্চলে তাঁর রাজনীতি চটকল মজদুরদের নিয়ে। চটকল মজদুরদের জন্য। তাঁর বাড়ির নাম ‘মজদুর ভবন’। তাঁদের পরিবারের প্রতি পাট শ্রমিকদের দীর্ঘকালীন আনুগত্য। অর্জুনও চেষ্টা করেন চটকল মজদুরদের ভাল-মন্দে জড়িয়ে থাকতে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি কেন্দ্রীয় সরকারের পাটনীতি নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন অর্জুন। বস্ত্রমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের সঙ্গে বৈঠকও করেছিলেন। সন্তুষ্ট হননি। তার অব্যবহিত পরেই তৃণমূলে ফেরেন অর্জুন।
ভাইপো-বাদ
বাবা-মা প্রয়াত। অর্জুনের নিকটতম পরিবার বলতে স্ত্রী ঊষা এবং পুত্র-কন্যা। কন্যা বিবাহিতা। তবে ভাই-ভাইপোদের ধরলে সে পরিবার অনেক বড়। পরিজনদের বেশির ভাগই অর্জুনের ঘনিষ্ঠ। তবে অর্জুনের এক ভাইপো ভোটে সিংহের প্রবল প্রতিপক্ষ পার্থ ভৌমিকের নির্বাচনী এজেন্ট হয়েছেন। কাকতালীয়। কিন্তু তৃণমূলে ফেরার সময় ‘ভাইপো’ অভিষেকের হাত থেকে ঝান্ডা নিয়েছিলেন অর্জুন। তৃণমূলের ব্রিগেড সমাবেশে সেই ‘ভাইপো’র ঘোষিত প্রার্থিতালিকায় তাঁর নাম রইল না। অর্জুন ফেরত গেলেন বিজেপিতে। ভাইপোরা কি তাঁর কাটা? না কি ভাইপোয় অর্জুনের তার কাটা?
অর্জুন কলিং অর্জুন
ব্যারাকপুর লোকসভার ভোটে মুখোমুখি অর্জুন বনাম পার্থ। বিজেপির অর্জুন বনাম তৃণমূলের পার্থ। ‘বাহুবলী’ অর্জুন বনাম ‘গ্রুপ থিয়েটার শিল্পী’ পার্থ। অর্জুনের অপর নামও তো পার্থ। অতএব ব্যারাকপুরে যুদ্ধ অর্জুন বনাম অর্জুন। ব্যারাকপুরে অর্জুন কলিং অর্জুন।
শ্যামের বাঁশি
গত দু’বছর তৃণমূলে থাকাকালীন অর্জুনকে সবচেয়ে বেশি বেগ দিয়েছেন জগদ্দলের সোমনাথ শ্যাম। শিল্পাঞ্চলের রাজনীতিতে সোমনাথের ‘পুঁজি’ হল অর্জুন-বিরোধিতার। সোমনাথ কংগ্রেস করতেন। ২০১৯ সালে অর্জুন বিজেপিতে যাওয়ার পরদিনই তৃণমূলে। অর্জুন তৃণমূলে ফেরার পরে সোমনাথের সঙ্গে সংঘাত এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে, কলকাতা থেকে বৈঠক করতে দৌড়ে যেতে হয়েছিল সুব্রত বক্সীকে। সোমনাথ অবশ্য পাত্তাই দেননি। বৈঠকেও যাননি। অর্জুন যাতে ব্যারাকপুর লোকসভায় টিকিট না পান, তার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন আগাগোড়া। দেখা যাচ্ছে, শ্যামের বাঁশি ঠিক সুরেই বেজেছিল।
সফেদি কি চমকার
বয়স এখন বাষট্টি। চেহারা বাহুবলী। কিন্তু বয়সের নিরিখে প্রৌঢ়ই বলা যায়। পোশাক মানেই ধবধবে সাদা। সাদা জামা, সাদা ট্রাউজার্স, সাদা জুতো, হাতঘড়ির সাদা ডায়াল এবং স্ট্র্যাপ। সে সাদায় কোনও কাদা নেই। ইদানীং সাদা ছেড়ে অন্য রঙেরও স্নিকার্স পরছেন। তবে অর্জুনের চুল-গোঁফ মিশমিশে কালো। দেখলে মনে হবে সদ্য চল্লিশ পেরোলেন।
কফি উইথ কুকিজ়
অর্জুনের শিকড় বিহারে। আড্ডার মুডে থাকলে তাঁর আলোচনা জুড়ে থাকে বিহারের রাজনীতি। কফির সঙ্গে কুকিজ় খেতে পছন্দ করেন। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে পটনা, পূর্ণিয়া, ছাপড়া-সহ বিভিন্ন এলাকার ভোট সমীকরণ বলে যান গড়গড়িয়ে। অবলীলায়। বিহারের বিভিন্ন জেলার ভাষার টানে তিনি অনর্গল কথা বলতে পারেন। বলেনও, যখন চটকল মজদুরদের সঙ্গে সেতুবন্ধন করে তিনি।
দানাদার বনাম দমদার
পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালে মদন মিত্রের সঙ্গে অর্জুনের সংঘাত চরমে পৌঁছেছিল। মদন জোড়াফুলে। অর্জুন পদ্মফুলে। মদন আবার তখনই বিধানসভা উপনির্বাচনে লড়ছেন অর্জুন-তনয়ের বিরুদ্ধে। জোড়াফুল পদ্মফুলকে বলেছিলেন, বিটি রোড দিয়ে গেলে ‘দানা’ ভরে দেবেন। ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে পদ্মফুল জবাব দিয়েছিল, ‘মেশিন’ ধরতে পারেন?
মাছের চোখ
আরও ১৫ বছর সাংসদ থাকবেন। এই হল অর্জুনের ‘মাছের চোখ’। বাকি কোনও কিছুর তোয়াক্কা তিনি করেন না। একটা ভোট শেষ হলে পরদিন থেকে পরের ভোটের প্রস্তুতি শুরু করেন। তাঁর গাণ্ডীব সবসময় হাতেই থাকে। পিঠে থাকে তূণ। তাতে তৈরি থাকে প্ল্যান এ-বি-সি। তিনি জানেন, রাজনীতির স্রোতের মুখ যখন-তখন যে কোনও দিকে ঘুরে যেতে পারে। কে তাঁকে পাল্টিবাজ বলল, কে গিরগিটির শরীরে তাঁর মুখ বসিয়ে ছবি বানাল, তাতে তাঁর কিছু যায়-আসে না!