রা-হুল!
২০১৪ সালে অমেঠিতে হেরেছিলেন রাহুল গান্ধীর কাছে। ২০১৯ সালে সেই অমেঠিতেই তাঁকে হারিয়ে লোকসভায় গিয়েছিলেন স্মৃতি জ়ুবিন ইরানি। পাঁচ বছর পর ২০২৪ সালে রাহুল আর অমেঠিতে ফেরত আসেননি। কেরলের ওয়েনাড়ে ভোট হয়ে যাওয়ার পরে গুটি গুটি গিয়ে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন রায়বরেলী কেন্দ্র থেকে। যেখানে গত লোকসভা ভোটে জিতেছিলেন তাঁর মা সনিয়া। স্মৃতি অবশ্য এ বারও প্রার্থী অমেঠিতেই। সঙ্গে টিপ্পনী, ‘‘পালালেন, তিনি পালালেন!’’ কাকে বললেন বলতে পারার জন্য কোনও পুরস্কার নেই।
আমাকে রোগা বোলো না
এখন বেশ হৃষ্টপুষ্ট হলেও একটা সময়ে বেজায় রোগা ছিলেন। তা নিয়ে বাছা-বাছা এবং চোখা-চোখা মন্তব্য যে শুনতে হয়নি, তা-ও নয়। সেই রোগাপাতলা থাকার দিনগুলোয় তাঁকে বহু প্রোডাকশন হাউস অভিনয়ে সুযোগ দিতে গিয়ে নাক সিঁটকেছিল। কেউ কেউ সরাসরি বলে দিয়েছিল, তাঁর দ্বারা কিস্যু হবে না। বাকি তো ইতিহাস! এখন নিজের সেই কঙ্কালসার চেহারার ছবি দেখলে তাঁর নিজেরই বেদম হাসি পায়।
বাসন থেকে বসন
একটা সময়ে ম্যাকডোনাল্ডসের স্টোরে কাজ করতেন। বাসন মাজার কাজ। মাসিক বেতন ছিল ১২০০ টাকা। কিন্তু ওই টাকা জমিয়ে জমিয়েই ‘মিস ইন্ডিয়া’ প্রতিযোগিতায় যাওয়ার পোশাক কিনেছিলেন স্মৃতি। বাসন ধোওয়ার অর্থে বসনের জোগাড় করে ১৯৯৮ সালের ‘মিস ইন্ডিয়া’ সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে জায়গাও করে নিয়েছিলেন।
একতাই কপূর, একতাই বল
থিয়েটারে অভিনয় করতেন স্মৃতি। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রযোজনা সংস্থায় ‘অডিশন’ দিতেন। কোনওটায় প্রথমেই বাতিল। কোনওটায় বাতিল দু’এক ধাপ পেরোনোর পরে। সেই ভাবেই এক দিন একতা কপূরের অফিসে গিয়েছিলেন। তাঁকে দেখেই পছন্দ হয়ে যায় ‘সিরিয়াল কুইন’ পরিচালক-প্রযোজকের। সে দিনই চুক্তি সই। রোজগার করতেন মাসে ১২০০ টাকা। সেখান থেকে একলাফে শুটিং থাকলে দিনে ১৮০০ টাকা! অতঃপর ‘কিঁউ কি সাস ভি কভি বহু থি’। স্মৃতি অভিনয় শুরু করেন ‘তুলসী’ চরিত্রে। যে সিরিয়াল খ্যাতির পাশাপাশি তাঁর জন্য খুলে দিয়েছিল রাজনীতি তথা বিজেপির দরজা।
কে কোথা ধরা পড়ে!
২০০১ সালে স্মৃতি বিয়ে করেন পার্সি ব্যবসায়ী জ়ুবিন ইরানিকে। জ়ুবিনের সেটি দ্বিতীয় বিবাহ। তাঁর প্রথম স্ত্রী মোনা ইরানি। ঘটনাচক্রে, ‘মিস ইন্ডিয়া’ প্রতিযোগিতার সময় মোনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল স্মৃতির। তিনি ছিলেন ‘ইভেন্ট কো-অর্ডিনেটর’। অতঃপর তাঁর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন স্মৃতি। জ়ুবিন-মোনার এক কন্যাসন্তান রয়েছেন। তিনি স্মৃতির কাছেই থাকেন। স্মৃতি-জ়ুবিনের দুই সন্তান। পুত্র জ়োহর। কন্যা জ়ইশ।
কমলবনে
২০০৩ সালে বিজেপিতে যোগ দেন স্মৃতি। ২০০৪ সালে মহারাষ্ট্রের বিজেপি যুব মোর্চার সহ-সভাপতির দায়িত্ব পান। সেই বছরেই লোকসভা ভোটে দিল্লির চাঁদনি চক কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে ভোট লড়েন। হারেন তখন কংগ্রেসের, এখন সমাজবাদী পার্টির কপিল সিব্বলের কাছে। কিন্তু প্রথম বার লোকসভা ভোটে হার এবং বাজপেয়ী সরকারের পতনের জন্য স্মৃতি দায় চাপিয়েছিলেন তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপর। এ-ও ঘোষণা করেছিলেন যে, মোদী মুখ্যমন্ত্রিত্বে ইস্তফা না-দিলে তিনি আমরণ অনশন শুরু করবেন! তবে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ধমকে ‘বিদ্রোহ’ থামাতে হয় তাঁকে। ২০১১-২০১৯ পর্যন্ত রাজ্যসভায় বিজেপি সাংসদ।
আ-মোদীত
যে মোদীর পদত্যাগ দাবি করেছিলেন একদা, সেই মোদীর মন্ত্রিসভাতেই ঠাঁই হয় স্মৃতির। প্রথমে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী হন। তখন কেন্দ্রে পৃথক শিক্ষা মন্ত্রক ছিল না। মানবসম্পদ মন্ত্রকের অধীনেই ছিল শিক্ষা। স্মৃতিকে শিক্ষামন্ত্রীর পদে বসানোয় বিস্তর বিতর্ক হয়েছিল। কারণ, তাঁর প্রথাগত উচ্চশিক্ষা ছিল না। দিল্লির অক্সিলিয়াম স্কুলের পর স্নাতক স্তরে পড়েননি। পরে বিকম প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিলেও তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স তাঁর করা ছিল না। গত দশ বছরে মোদীর মন্ত্রিসভায় অনেক দফতর সামলেছেন স্মৃতি। কখনও মানবসম্পদ, কখনও বস্ত্র, কখনও আবার নারী ও শিশুকল্যাণ।
বং কানেকশন
দাদু বাংলার। মা শিবানী বাগচি খাঁটি বাঙালি। স্মৃতি নিজেও ভাল বাংলা বলতে পারেন। সেই কারণেই তাঁকে দিয়ে বাংলায় সভা-টভা করিয়ে থাকে বিজেপি। অথবা ফোন-টোন। তবে স্মৃতি ভারত সরকারের মন্ত্রীও বটে। আর তাঁর পরিবার ‘মিনি’ ভারত। ঠাকুর্দা পঞ্জাবি, ঠাকুমা মরাঠি, দিদা অসমের, দাদু বাংলার, স্বামী জ়ুবিন ইরানি পার্সি। বাবা অজয় কুমার মলহোত্র পঞ্জাবি। মা বাঙালি।
পেটুকপুরাণ
দেশের কোন শহরের কোন দোকানে কী কী ভাল খাবার পাওয়া যায়, সব জানেন স্মৃতি। যেমন পওয়াইয়ের কোন ঘুপচি দোকানে পাতলা জিলিপি পাওয়া যায়। দাদারে কোন সিগন্যালের পাশের দোকানের মটকা কুলফি ভাল খেতে। তবে ফুচকা সবচেয়ে প্রিয়। দিল্লিতে ফুচকা খেতে ইচ্ছে হলে স্মৃতির ফোন যায় এক নির্দিষ্ট ফুচকাওয়ালার কাছে। যিনি গরমকালে তেঁতুলজলে বরফ ব্যবহার করেন। সেই ফুচকাওয়ালার তিন প্রজন্ম চেনে স্মৃতিকে। স্মৃতিও চেনেন তাঁদের।
সবই মায়া
বাঁধন বাড়িয়ে লাভ নেই। কোনও কিছুর সঙ্গে বেশি মাখামাখি করার দরকার নেই। সাংসদ হওয়া থেকে মন্ত্রিত্ব সামলানো— সব কাজ। এগুলো কাজের মতো করেই দেখতে হয়। কাজের মতো করে যত্নে করতে হয়। মাখামাখি হলে বন্ধন বাড়ে। তাতে লাভ নেই! ছাড়তে কষ্ট হয়। গত ১০ বছর ধরে স্মৃতি মন্ত্রিসভার সদস্য। একাধিক দফতর বদল হয়েছে তাঁর। অসুবিধা হয়নি। বন্ধন নেই যে। সবই মায়া!
রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী