Tiruppur

তিরুপুরে ভাটার টান, কাজ খুঁজতে খালিদরা ফিরছেন নয়া অযোধ্যায়

ভোট দিতে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন না কি? উত্তর এল, পেটের চিন্তায় ভোট মাথায় উঠেছে। এ দিকে ছোটখাটো কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। টানা কাজ মিলছে না।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

তিরুপুর (তামিলনাড়ু) শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০২৪ ০৭:৩১
Share:

—প্রতীকী ছবি।

জিতেন্দ্র যাদব, খালিদ আখতার বহু দিনের ইয়ারদোস্ত। বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে গনগনে রোদের মধ্যে তিরুপুর রেল স্টেশনে অপেক্ষা করছেন। সঙ্গে কাচ্চাবাচ্চা সমেত গোটা পরিবার। ট্রেন ধরবেন। প্রথমে লখনউ। তার পর বাসে করে নিজেদের গ্রাম।

Advertisement

ভোট দিতে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন না কি? উত্তর এল, পেটের চিন্তায় ভোট মাথায় উঠেছে। এ দিকে ছোটখাটো কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। টানা কাজ মিলছে না। দু’মাস কাজ থাকে তো ১৫ দিন রোজগার বন্ধ। কারখানার বাবুরা বলেন, ‘এক্সপোর্টের অর্ডার’ কমে যাচ্ছে। জিতেন্দ্র উত্তর করেন, ‘‘শুনছি, উত্তরপ্রদেশে এখন খেটেখাওয়ার অনেক কাজ মিলছে! সরকার অনেক কাজ করছে। গিয়ে দেখি।’’ বিড়িতে শেষ টান দিয়ে খালিদ বলেন, ‘‘রামমন্দির হয়েছে বুঝলেন কি না। তার পর থেকেই উত্তরপ্রদেশে আজ উড়ালপুল, কাল সেতু, পরশু নতুন হাইওয়ে। মনে হচ্ছে, গ্রামে ফিরে কাজকর্ম জুটে যাবে! তাই তিরুপুরের মায়া কাটিয়ে চললাম।’’

শহরের নাম তিরুপুর। তামিলনাড়ুর এই শহরের ওটা পোশাকি নাম। আসল পরিচয়, দেশের পোশাক শিল্পের রাজধানী। কেউ বলে, ‘নিটওয়্যার ক্যাপিটাল’। কেউ ডাকেন ‘টেক্সটাইল টাউন’। হাজার দশেক কারখানা। অধিকাংশই ছোট-মাঝারি শিল্প। প্রায় ছয় লক্ষ মানুষ কাজ করেন। তার প্রায় অর্ধেক উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্য থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিক। তামিলনাড়ুর এই শহরে তাই নজর করলেই হিন্দিতে লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে।

Advertisement

লোকসভা ভোটের উৎসবে তিরুপুরের মন ভাল নেই। কারণ পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ, ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযেগিতায় পিছিয়ে পড়ছে তিরুপুর। দেশের বাজারে কাঁচামালের খরচ বাড়ছে। ও দিকে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ সস্তায় পোশাক নিয়ে তৈরি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আমেরিকা, ইউরোপের বাজারে অনিশ্চয়তা। রফতানির বাজার ছোট হচ্ছে। ইতিউতি কারখানায় ঝাঁপ পড়ছে। ভিন রাজ্যের শ্রমিকরা দিশেহারা।

তিরুপুরের এক পোশাক কারখানার মালিক বললেন, ‘‘কেন্দ্রের মোদী সরকার ও যোগী আদিত্যনাথ সরকার আজকাল উত্তরপ্রদেশে পরিকাঠামোয় অনেক টাকা ঢালছে। বিপুল নির্মাণ কাজ চলছে। ফলে শ্রমিকরা নিজেদের রাজ্যে ফিরে যাচ্ছেন। এখানে থাকতে বললে বেশি মজুরি চাইছেন। তাতে পোশাক তৈরির খরচ আরও বেড়ে যাচ্ছে। রফতানির প্রতিযোগিতায় এঁটে ওঠা যাচ্ছে না।’’ স্বাভাবিক ভাবেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যবসায়ীর মন্তব্য, ‘‘এ এক নতুন উৎপাত। কিন্তু এ নিয়ে আর কাকে নালিশ করব?’’

মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় বলেছিলেন, দেশের রফতানির গতি বাড়লেই ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের উপরে উঠতে পারে। এ দিকে দেশের বস্ত্র-পোশাক শিল্পের রফতানি পরপর দু’বছর ধাক্কা খেয়েছে। ২০২১-২২-এ পোশাক-বস্ত্রের রফতানির পরিমাণ ছিল ৪১০০ কোটি ডলার। ২০২২-২৩-এ তা কমে ৩৫০০ কোটি ডলারের ঘরে চলে গিয়েছিল। ২০২৩-২৪-এ তা আরও কমে ৩৪৪০ কোটি ডলারে নেমেছে। তিরুপুর রফতানিকারী সংগঠনের প্রাক্তন সভাপতি রাজা এম সম্মুগম বলছেন, ‘‘এর ধাক্কা তিরুপুরের টেক্সটাইল টাউনেও এসে পড়েছে। তিরুপুরের রফতানি ৪০০ কোটি ডলার থেকে ৩০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। আমেরিকা, ইউরোপের রফতানি ধাক্কা খেয়েছে।’’ এমনিতেই অনেক দেশে মন্দারআবহ। কেনাকাটা কমেছে। তার পরে ইউক্রেন যুদ্ধ অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। রেড সি-তে জাহাজ চলাচল নিয়ে সমস্যায় পরিবহণের খরচ বেড়েছে। সম্মুগম মনে করিয়ে দেন, ‘‘কোভিডের সময় তিরুপুর বড় ধাক্কা খেয়েছিল। এখন প্রায় একই রকম খারাপ দশা। কেন্দ্রীয় সরকারের এখনই জরুরি ভিত্তিতে সহজে ঋণের ব্যবস্থাকরা দরকার।’’

ভোটের মরসুমে সব দলই এসে তিরুপুরের শিল্পমহলকে আশ্বাস দিচ্ছে, ক্ষমতায় এলেই তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু শিল্পমহলের অভিজ্ঞতা বলছে, রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের আগে এসে চাঁদা চায়। কিন্তু সমস্যা বুঝতে চায় না। তিরুপুরের ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, যে কোনও শিল্পাঞ্চলে যদি কেন্দ্রের শাসক দলের সাংসদ থাকেন, তা হলে কিছু সুবিধা মেলে। না হলে ভোটের পালাবদলে তাদের কোনওলাভ হয় না।

তা হলে কি শিল্পাঞ্চলের ভোট নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি পাবে?

তিরুপুরের নেতাজি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পার্কে অনিশ্চয়তা ঘুরপাক খায়। দেশের রফতানিকারীদের সংগঠন ‘ফিও’ ভবিষ্যৎবাণী করেছে, আন্তর্জাতিক বাজারের অনিশ্চয়তা নতুন অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসেও বজায় থাকবে। এ দেশ থেকে জাহাজে করে পণ্য রফতানিতেও তার প্রভাব পড়বে। ফলে চিন্তা কমছে না তিরুপুরের। আরও কিছু কারখানায় হয়তো ঝাঁপ পড়বে। তা হলে ‘দিন আনি, দিন খাই’ শ্রমিকরা কী করবেন?

তিরুপুর থেকে ট্রেনে উঠে পড়েন জিতেন্দ্র, খালিদ। অনেকখানি ট্রেন যাত্রা। তামিলনাড়ু থেকে উত্তরপ্রদেশের দিকে ফের উল্টো পথে ফেরা। রুটিরুজির টানে আসা-যাওয়া। জিতেন্দ্র বলেন, ‘‘ভাগ্যে যা আছে, তাই হবে। প্রভু রামজি আছেন, তিনিই দেখবেন!’’ আর ভোট? খালিদ বলেন, ‘‘যাচ্ছি যখন, গ্রামে গিয়ে ভোটটাও দিয়ে দেব। কালো কালি লাগানো আঙুল মুখের সামনে ধরে মোবাইলে একখানা ছবি তোলা তো হবে!’’

(চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement