গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
বাংলায় যুযুধান দুই দল তৃণমূল এবং বিজেপি অনেক দলীয় বিধায়ককে লোকসভা ভোটে প্রার্থী করেছিল। তাঁদের অনেকে জিতেছেন, অনেকে হেরেও গিয়েছেন। তবে লোকসভা কেন্দ্র ধরে ধরে বিধানসভাওয়াড়ি ফল পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ বিধায়কই তাঁদের বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে থাকতে পেরেছেন। আবার কেউ কেউ অনেক পিছিয়ে পড়েছেন প্রতিপক্ষের থেকে।
ঘটনাচক্রে, বিজেপির যে তিন বিধায়ক তৃণমূলে গিয়ে তাদের টিকিটে লোকসভায় লড়েছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই যেমন লোকসভা ভোটে হেরেছেন, তেমনই পিছিয়ে রয়েছেন নিজেদের বিধানসভা কেন্দ্রেও।
বিজেপির টিকিটে ২০২১ সালে রায়গঞ্জ বিধানসভায় জিতে ২০২৪ সালে তৃণমূলের টিকিটে রায়গঞ্জ লোকসভায় লড়েছেন কৃষ্ণ কল্যাণী। লোকসভায় হারের পাশাপাশি তিনি নিজের বিধানসভাতেও ৪৭ হাজার ভোটে পিছিয়ে। একই ভাবে বিজেপির টিকিটে বিধানসভায় জিতে লোকসভায় তৃণমূলের প্রার্থী হওয়া রানাঘাটের মুকুটমণি অধিকারী এবং বনগাঁর বিশ্বজিৎ দাসও নিজেদের বিধানসভায় পিছিয়ে রয়েছেন। মুকুটমণির বিধানসভা রানাঘাট দক্ষিণে তৃণমূল পিছিয়ে রয়েছে ২৭ হাজার ভোটে। বিশ্বজিতের বিধানসভা বাগদায় তৃণমূল পিছিয়ে ২০ হাজার ভোটে। খারাপ ফলাফলের প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মুকুটমণি বলেছেন, ‘‘আমাদের কিছু সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল। সব জায়গায় সমান ভাবে পৌঁছতে পারিনি। তা ছাড়া মতুয়া ভোটের অনেকটা অংশ আমরা পাইনি।’’
কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন সিতাইয়ের বিধায়ক জগদীশচন্দ্র বসুনিয়া। তিনি যেমন লোকসভা ভোটে জিতেছেন, তেমনই নিজের কেন্দ্র সিতাইও ধরে রেখেছেন। সিতাইয়ে তৃণমূল এগিয়ে ২৮ হাজার ভোটে। আবার জলপাইগুড়ির তৃণমূল প্রার্থী তথা ধূপগুড়ির বিধায়ক নির্মলচন্দ্র রায় লোকসভায় পরাস্ত হওয়ার পাশাপাশি নিজের বিধানসভাও ধরে রাখতে পারেননি। ধূপগুড়িতে তৃণমূলের চেয়ে বিজেপি এগিয়ে রয়েছে ৬৩ হাজার ভোটে। কয়েক মাস আগে এই ধূপগুড়ি বিধানসভার উপনির্বাচনেই জিতেছিলেন তৃণমূলের এই নির্মলই। বিজেপির হাতে থাকা ধূপগুড়ি বিধানসভা আসন উপনির্বাচনে জিতেছিল তৃণমূল। ঘটনাচক্রে, ভোটের আগে এই ধূপগুড়িই ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। রাতেই সেখানে পৌঁছে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পর দিন পৌঁছন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া নিয়েও চাপানউতর চলেছিল। তৃণমূল জলপাইগুড়ি আসন জয়ের আশা করেছিল ধূপগুড়ির উপর ভরসা করেই। কিন্তু সেখানেই তারা বিরাট ব্যবধানে পিছিয়ে। কেন এমন হল? নির্মল বিশেষ কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তিনি শুধু বলেন , ‘‘দলের মধ্যে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে পর্যালোচনা হবে। তার আগে এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না।’’
আলিপুরদুয়ার লোকসভায় বিজেপির প্রার্থী হিসেবে লড়েছিলেন মনোজ টিগ্গা। তিনি মাদারিহাটের বিধায়ক। লোকসভায় জেতার পাশাপাশি তিনি নিজের বিধানসভাতেও এগিয়ে রয়েছেন ১১ হাজার ভোটে। আবার কার্শিয়াঙের বিজেপি বিধায়ক বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা নির্দল প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন দার্জিলিং কেন্দ্রে। কিন্তু তাঁর জামানত তো বাজেয়াপ্ত হয়েছেই, পাশাপাশিই নিজের বিধানসভায় তিনি ভোট পেয়েছেন সাকুল্যে ১ হাজার ৬৮টি।
লোকসভা ভোটে হারলেও নিজেদের বিধানসভায় এগিয়ে রয়েছেন, এমনও অনেক প্রার্থী রয়েছেন। মালদহ দক্ষিণের বিজেপি প্রার্থী শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী তাঁর নিজের বিধানসভা ইংরেজবাজারে এগিয়ে রয়েছেন ৮২ হাজার ভোটে। মুর্শিদাবাদের বিজেপি প্রার্থী গৌরীশঙ্কর ঘোষ তাঁর নিজের বিধানসভা মুর্শিদাবাদে ৮ হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছেন। বালুরঘাটের তৃণমূল প্রার্থী তথা রাজ্যের মন্ত্রী বিপ্লব মিত্র লোকসভায় হারলেও নিজের বিধানসভা হরিরামপুরে এগিয়ে রয়েছেন ১০ হাজারের বেশি ভোটে। কাঁথির তৃণমূল প্রার্থী উত্তম বারিকও লোকসভায় পরাস্ত হলেও নিজের বিধানসভা পটাশপুরে ৮ হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে রয়েছেন।
এ ছাড়া ব্যারাকপুরের পার্থ ভৌমিক, বাঁকুড়ার অরূপ চক্রবর্তী, মেদিনীপুরের জুন মালিয়া এবং বসিরহাটের হাজি নুরুল ইসলাম লোকসভায় জেতার পাশাপাশি নিজেদের বিধানসভাতেও এগিয়ে রয়েছেন। এঁদের মধ্যে নিজের বিধানসভায় সবচেয়ে বেশি ভোটে এগিয়ে হাজি নুরুল। নিজের বিধানসভা কেন্দ্র হাড়োয়ায় তাঁর ‘লিড’ ১ লক্ষ ১১ হাজার। সবচেয়ে কম ‘লিড’ পেয়েছেন জুন। নিজের বিধানসভা কেন্দ্র মেদিনীপুরে তাঁর ‘লিড’ কমবেশি ২ হাজার ভোট।
এ ছাড়াও আরও চার জন বিধায়ক প্রার্থী ছিলেন লোকসভায়। সকলেই বিজেপির। তবে তাঁরা যে লোকসভায় প্রার্থী হয়েছিলেন, তাঁদের বিধানসভা কেন্দ্র সেই লোকসভার মধ্যে নয়। লোকসভায় তাঁরা সকলেই হেরেছেন। কিন্তু নিজের নিজের বিধানসভায় এগিয়ে রাখতে পেরেছেন নিজের দলকে।
অগ্নিমিত্রা পাল মেদিনীপুর লোকসভায় প্রার্থী ছিলেন। তিনি আসানসোল দক্ষিণের বিধায়ক। আসানসোলে বিজেপি হারলেও অগ্নির বিধানসভায় ১২ হাজার ভোটের লিড পেয়েছে পদ্মশিবির। বারাসতে বিজেপির প্রার্থী ছিলেন স্বপন মজুমদার। তিনি হেরেছেন। কিন্তু তাঁর বিধানসভা বনগাঁ দক্ষিণে ১৯ হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। অসীম সরকার বর্ধমান পূর্বে প্রার্থী ছিলেন। তিনিও হেরে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বিধানসভা হরিণঘাটায় বিজেপি ১১ হাজার ভোটে জিতেছে। হরিণঘাটা বনগাঁ লোকসভার অন্তর্গত। হিরণ চট্টোপাধ্যায় ঘাটালে বিজেপির প্রার্থী ছিলেন। অভিনেতা দেবের কাছে তিনি হেরেছেন। কিন্তু তাঁর বিধানসভা খড়্গপুর সদরে বিজেপির ‘লিড’ রয়েছে ২২ হাজার।