(বাঁ দিকে) তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
উত্তর কলকাতার সাংসদ তথা তৃণমূলের সাংগঠনিক জেলার সভাপতি সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে শুক্রবারই ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন কুণাল ঘোষ। তাঁর আগে কুণাল দলের মুখপাত্র এবং রাজ্য সাধারণ সম্পাদকের পদ ছেড়ে দেন। শনিবার এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) আবার সেই সুদীপের বিরুদ্ধেই তোপ দাগলেন তিনি। তবে সেই সঙ্গে এ-ও জানালেন, দুপুরে দলের কর্মসূচিতে তিনি থাকবেন। এক্সের পোস্টে কুণাল লিখেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেনাপতিত্বে আসন্ন ব্রিগেড সমাবেশের প্রচারে রাজাবাজার মোড় থেকে শ্রদ্ধানন্দ পার্ক পর্যন্ত তৃণমূল কর্মীদের মিছিল। থাকব।’’ আগামী ১০ মার্চ তৃণমূল ব্রিগেডে ‘জনগর্জন সভা’ করবে। শনিবারের মিছিল তারই প্রচারের স্বার্থে আয়োজিত।
এর পরেই কুণাল আরও একটি পোস্ট করেন নিজের হ্যান্ডলে। সেখানে রাখঢাক না করে সুদীপের নামে সরাসরি তোপ দেগেছেন। সুদীপ ভুবনেশ্বরের হাসপাতালে থাকাকালীন কে হাসপাতালের বিল মিটিয়েছেন, তা তদন্তসাপেক্ষ বলে মন্তব্য করেছেন কুণাল। আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে তিনি এ-ও জানিয়েছেন, সুদীপ কয়লা ‘দুর্নীতি’র সঙ্গে জড়িত। তা যদি প্রমাণিত হয়, তবে তাঁকে গ্রেফতার করার দাবিও তুলেছেন কুণাল। লিখেছেন, ‘‘সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এবং তাঁর হয়ে ভুবনেশ্বর অ্যাপোলো হাসপাতালের বিল মেটানোর নথি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তিনি যখন বন্দি ছিলেন, তাঁকে বড় অঙ্কের টাকা দেওয়া হয়েছিল, না কি তাঁর হয়ে হাসপাতালের বিল কেউ মিটিয়ে দিয়েছিলেন, তদন্ত করে দেখতে হবে। যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে কয়লা ‘দুর্নীতি’র সঙ্গে ওই টাকার যোগ থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে তদন্তের স্বার্থে সুদীপকে গ্রেফতার করা উচিত। যদি কেন্দ্রীয় সংস্থা এটি এড়িয়ে যায়, আমি আদালতের দ্বারস্থ হব।’’
এর আগে শুক্রবার সন্ধ্যাতেও সুদীপের নাম করে তোপ দেগেছিলেন কুণাল। সুদীপকে ‘বিজেপির লোক’ বলে অভিহিত করে তিনি বলেছিলেন, ‘‘উত্তর কলকাতায় এ বার পদ্মফুল বনাম পদ্মফুলের লড়াই হবে। সুদীপবাবু দাঁড়াবেন জোড়াফুলের হয়ে। কিন্তু আসলে তিনি পদ্মফুলের লোক।’’ উত্তর কলকাতায় দলের সংগঠন নিয়েও ক্ষোভ চেপে রাখেননি কুণাল। বলেন, ‘‘উত্তর কলকাতায় যা হচ্ছে, তা দলের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। একে তো কোনও জেলা দফতর নেই। ক্যালকাটা বয়েজ় স্কুলে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি ঘর দখল করে অফিস চালাচ্ছেন। ওঁকে নাকি কোন মিশনারিজ় অনুমতি দিয়েছে। কী করে একটি স্কুলে রাজনীতির আখড়া চলতে পারে?’’
কুণালের সুদীপকে আক্রমণের এই গোটা পর্বে উত্তর কলকাতার সাংসদ নীরব রয়েছেন। তিনি প্রকাশ্যে এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। সুদীপ ফোন ধরেননি। তাঁর মোবাইলে পাঠানো বার্তারও জবাব আসেনি। যদিও তৃণমূলের সূত্রের খবর, সুদীপ দলনেত্রীকে গোটা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত রেখেছেন।
বস্তুত, কুণাল-সুদীপের ‘মধুর’ সম্পর্কের কথা তৃণমূলে কারও অজানা নয়। শুক্রবার দুপুরে কুণাল এক্সে রোজ়ভ্যালি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সুদীপের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছিলেন। যদিও সেই পোস্টে তিনি কারও নাম করেননি। বলেছিলেন, ‘‘মোদী বাংলার মাটিতে একরাশ কুৎসা করে গেলেন। যুক্তিতে তাঁকে ধুয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ঘটনা হল, তাঁর কড়া সমালোচনার মূল দায়িত্ব যাঁদের, দু’টি আলাদা বিরোধী দলের লোকসভার দলনেতারা তো প্রধানমন্ত্রীরই লোক। এঁদের সঙ্গে বিজেপির যোগাযোগ। এই দু’জনকে দু’ভাবে ব্যবহার করেন মোদী। এক জনকে রোজ়ভ্যালি থেকে বাঁচিয়ে গলায় বকলস পরিয়ে রেখেছেন।’’
সুদীপ-বিজেপি বোঝাপড়া বোঝাতে গিয়েই যে রোজ়ভ্যালি প্রসঙ্গ টানা হয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এই রোজ়ভ্যালি মামলাতেই সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়ে বেশ কয়েক মাস ভুবনেশ্বর জেলে কাটাতে হয়েছিল সুদীপকে। সে সময়ে তিনি অসুস্থ হয়ে ভুবনেশ্বর অ্যাপোলো হাসপাতালেও ভর্তি ছিলেন কিছু দিন। কুণাল-ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, বিজেপির সঙ্গে বোঝাপড়ার কারণে সেই মামলা নিয়ে সুদীপকে আর ঝক্কি পোহাতে হয় না। কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলের যে অংশ সরব, তাঁদের বিরুদ্ধেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। শনিবার কুণালের পোস্টেও সেই ইঙ্গিত রয়েছে।
বিতর্কের সূত্রপাত বৃহস্পতিবার রাতে। এক্স হ্যান্ডলেই কুণাল রাতে লিখেছিলেন, ‘‘নেতা অযোগ্য গ্রুপবাজ স্বার্থপর। সারা বছর ছ্যাঁচড়ামি করবে আর ভোটের মুখে দিদি, অভিষেক, তৃণমূল দলের প্রতি কর্মীদের আবেগের উপর ভর করে জিতে যাবে, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি করবে, সেটা বার বার হতে পারে না।’’ তৃণমূলের অন্দরে যখন কুণালের এই পোস্ট নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে, তখন শুক্রবার সকালে হঠাৎ দেখা যায়, তিনি এক্স হ্যান্ডলের বায়ো থেকে তৃণমূল মুখপাত্র তথা রাজনীতিকের পরিচয়টাই মুছে ফেলেছেন। সেখানে এখন তাঁর পরিচয় শুধুই ‘সাংবাদিক আর সমাজকর্মী’।
তৃণমূল সূত্রে খবর, ব্রিগেডের সভা উপলক্ষে বৃহস্পতিবার উত্তর কলকাতা তৃণমূলের প্রস্তুতি সভা ছিল। সেই সভায় কুণালকে ডাকা হয়নি। তার পর রাতেই এক্স হ্যান্ডলে ক্ষোভ উগরে দেন কুণাল। দলের পদ ছেড়ে সরাসরি সুদীপের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে শুরু করেন।
উল্লেখ্য, যে উত্তর কলকাতার সংগঠন নিয়ে কুণালের এত অসন্তোষ, যে কেন্দ্রের সাংসদকে নিয়ে তাঁর ক্ষোভ, সেই উত্তর কলকাতাতেই শনিবার দলের কর্মসূচিতে থাকছেন কুণাল। আগের দিন যখন তিনি দলের পদ ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন, তখন তিনি এ-ও জানান, দলের সৈনিক হিসাবে থাকতে চান। দলবদলের রটনা অমূলক। শনিবার দলের কর্মসূচিতে থেকে ‘সৈনিক’ হিসাবেই ব্রিগেডের প্রস্তুতি সারবেন কুণাল।