—প্রতীকী ছবি।
বুথজ্যাম, ছাপ্পা বা রিগিং শব্দটিও বাঙালির অভিধানে ঢুকতে বেশ কয়েকটি ভোট লেগে গিয়েছিল। “১৯৫২ সালে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ফলসভোটিং শব্দটা ছিল কলেজের ক্লাসে প্রক্সি দেওয়ার দুষ্টুমি”, বলছিলেন অর্থনীতির অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্য।
এমন নয় যে এ দেশের মনীষীপ্রতিম রাজনৈতিক নেতারা সব অপাপবিদ্ধ ছিলেন। ১৯২০-৩০এর দশকেও ভোটের সঙ্গে বাহুবলীদের অল্পস্বল্প যোগ খুঁজে পাওয়া যেত। তবে ভোট এলে পাড়ার সেই 'দাদারা' সাধারণত উপকারী স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হতেন। কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত ওরফে ফাটাকেষ্টর ছায়াসঙ্গী সুকৃতি দত্ত (ঢেঁপুদা) নিজে শিয়ালদহ বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটার। কিন্তু ভোটের দিন পড়ে থাকতেন তখনকার বিদ্যাসাগর কেন্দ্রে। ১৯৬০এর দশকের শেষ পর্যন্ত বিদ্যাসাগর কেন্দ্রে সিপিআই-এর আধিপত্য ভাঙতে কংগ্রেসিরা একফোঁটা চেষ্টা করেনি। ঢেঁপুদা বললেন, “কলকাতার ছবিটা বদলাল নকশাল আমল থেকেই। নকশালদের সঙ্গে আমাদের টক্করের নানা ঘটনায় ভোটটা প্রেস্টিজ ফাইট হয়ে ওঠে।” ফাটা-শিবির মানে, লালবাজারের এক কুখ্যাত গোয়েন্দা অফিসার তখন নকশাল দমনে তাদের হাতে খোদ পুলিশের গুলি-বন্দুক তুলে দিয়েছিল। ১৯৭১-র রক্তাক্ত প্রতিশোধের ভোটে অজাতশত্রু হেমন্ত বসু খুন হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে দুই কংগ্রেসি তরুণ চিররঞ্জন সরকার, অশোক দেও ফাটা কেষ্টর পাড়াতেই খুন হয়ে গেলেন। বিদ্যাসাগর
কেন্দ্রে কংগ্রেসের সামসুজ্জোহাকে জেতাতে মরিয়া হয় ফাটা-শিবির। তবে ঢেঁপুদার দাবি, “৭১-৭২এ ভোটের দিনে আমাদের অপারেশন কিন্তু বিকেলের আগে শুরু হয়নি। কেষ্টদার নিয়মই ছিল, সকালে পাবলিককে ডিসটার্ব করা হবে না। দুপুরের পরে প্রিসাইডিং অফিসারের সামনে দাঁড়ালেই কাদের ভোট পড়েনি, লিস্ট তুলে দিতেন। তারপরই যা হওয়ার ভদ্র ভাবে হত…!”
১৯৭২এর সেই ভোটে বেলা ১১টাতেই বাম-শিবির রাজ্য জুড়ে রিগিংয়ের প্রতিবাদে ভোট বয়কটের ঘোষণা করে দেয়। তবে কেশপুরের ত্রিকালদর্শী সিপিএম নেতা ডহরেশ্বর সেন বলছেন, “আমাদের ওখানে গোলমালটা ‘৭২এ ভোটের দিন তত বোঝা যায়নি। প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে স্ট্রংরুমে শয়ে শয়ে বাড়তি ব্যালট ঢোকানো হয়।”
একদা বৌবাজারে বিধানচন্দ্র রায়ের ভোটেও গোপাল পাঁঠা, ক্রিক রোয়ের ভানু বোসের ভূমিকার কথা শোনা যায়। বৌবাজারে বিধান রায়কে জেতাতে ব্যালট পেপারে কালি ঢালার অভিযোগও বহু চর্চিত। তবু প্রবীণদের মতে,ও সব ভোটের নিয়ম হয়ে ওঠেনি। সিপিএমের ডহরেশ্বর এটুকু মানেন, “ক্রমশ আমাদের (সিপিএম) দলেও ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার চেষ্টায় মরিয়া সুবিধাবাদী লোক বেড়েছে। তবে জনসমর্থন ছিলই।”
২০০১ সালে কেশপুরে নন্দরানি ডল কেশপুরে এক লক্ষ ৮ হাজার ভোটে জিতে রাজ্যের মন্ত্রী হন। জয়ের ব্যবধানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও অস্বস্তিতে পড়েন। ২০২৩-এর পঞ্চায়েত ভোটে দেখা যাচ্ছে রেকর্ড ধূলিসাৎ। কেশপুরে তৃণমূল এক লক্ষ ৬০ হাজার ভোট বেশি পেয়েছিল। তখন শাসক-শিবিরের একাংশে চাপা রসিকতা, দেখিস, ভোটারের থেকে বেশি ভোট না-পড়ে!
লালগড়ে মাওবাদীদের গুলি খেয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা সিপিএম কর্মী তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “বাম আমলে ধর্মপুরের অনুজ পান্ডেদের মতো কেউ রিগিং করত। কিন্তু তা এত সর্বাত্মক ছিল না।” তাঁর অভিযোগ, গত পঞ্চায়েত ভোটেই বিনপুর ১ ব্লকে ভোটের পরে ব্যালট বাক্স বদল করা হয়।
ভোট কুরুক্ষেত্রের অভিযোগ পাল্টা, অভিযোগ বারবারই পুরনো ইতিহাস খুঁড়ে আনে। লালগড়ের আর এক গুলিবিদ্ধ সিপিএম জিতেন মাহাতো এখন পদ্ম-শিবিরে। কেশপুরের প্রথম সারির তৃণমূল নেতা চিত্তরঞ্জন গরাই মনে রেখেছেন, ২০১১ সালে সিপিএমের মার খেয়ে তিন মাস কলকাতার নার্সিংহোম-বাসের অভিজ্ঞতা। কমিশনের খবরদারি, কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে সচেতনতার যুগ কি সত্যিই মুছতে পারবে বাংলার রক্তাক্ত ভোট-সংস্কৃতি?