প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —নিজস্ব চিত্র।
পাঁচ বছর আগে রাহুল গান্ধী যে ‘ভুল’ করেছিলেন, সেই একই ‘ভুল’ করে লালুপ্রসাদ যাদব বিজেপির হাতে তুলে দিলেন নতুন অস্ত্র। ‘মোদীর পরিবার’ নিয়ে আরজেডি প্রধানের মন্তব্যকে হাতিয়ার করে যে বিজেপি লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে নামবে, তা স্পষ্ট করে দিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বুধবার বারাসতে বিজেপির ‘নারী শক্তি বন্ধন’ সমাবেশে মোদী বলেন, ‘‘ওরা জানতে চায়, মোদীর পরিবার কোথায়? এই ঘোর পরিবারবাদী নেতারা, আপনারা দেখুন! আমার দেশের এই বোনেরা যাঁরা এসেছেন, যাঁরা দেশের কোনায় কোনায় আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তাঁরাই তো মোদীর পরিবার।’’
তবে বাংলায় দাঁড়িয়ে মোদী ওই দাবি করার পর পাল্টা আক্রমণ শানিয়েছে রাজ্যের শাসক তৃণমূল। বলা হয়েছে, অপরাধী, ধর্ষক এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের জন্যই মোদীর পরিবারের সদস্যপদ সংরক্ষিত। খোঁচা দেওয়া হয়েছে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মাদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়েও।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেস নেতা রাহুল ‘মোদী’ পদবি নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন। কর্নাটকের কোলারে একটি জনসভায় রাহুল বলেছিলেন, ‘‘সমস্ত চোরেদের নামেই কেন মোদী রয়েছে?’’ এর পরে মোদীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ নিয়ে সরব হয় বিজেপি। পরে তা আদালতেও যায়। এ বারেও একই ভাবে মোদীর হাতে ‘অস্ত্র’ তুলে দিয়েছেন লালুপ্রসাদ। গত সপ্তাহে গয়ায় লালুপ্রসাদকে খোঁচা দিতে গিয়ে মোদীর প্রধান অস্ত্র ছিল ‘পরিবারতন্ত্র’। সেই প্রসঙ্গ টেনে গত রবিবার পটনায় বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র এক জনসভায় বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘মোদী বার বার দাবি করেন, বিরোধীরা পরিবারের জন্য লড়ছেন। আমি বলতে চাই আপনার (নরেন্দ্র মোদী) তো পরিবারই নেই!’’ লালুর সেই মন্তব্যে নিন্দার ঝড় ওঠে পদ্মশিবিরে। অনেকেই বলতে শুরু করেন, ‘‘মোদীকে আক্রমণ করতে গিয়ে শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়েছেন লালু।’’ এর পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা-সহ বিজেপির ছোট-বড় নেতারা তাঁদের এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) নিজেদের নামের পাশে ‘মোদী কা পরিবার’ লেখেন। অর্থাৎ, সকলেই বোঝাতে চান, মোদী পরিবারহীন নন। তাঁরাই মোদীর পরিবার।
তেলঙ্গানায় একটি সভায় মোদী দাবি করেন, রাজনৈতিক ভাবে লড়াই করতে না পেরে বিরোধীরা তাঁর পরিবার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। দেশের ১৪০ কোটি মানুষ তাঁর পরিবারের সদস্য বলেও দাবি করেন। তবে সেটি ছিল সংক্ষিপ্ত জবাব। বুধবার বারাসতে বিস্তারিত ভাবে নিজের পরিবার চেনালেন মোদী।
বক্তৃতার শুরুতে বুধবার যে সব প্রকল্পের উদ্বোধন তিনি করলেন, তার বিবরণ দেন মোদী। এর পরেই সরাসরি ঢুকে পড়েন ‘পরিবার’ প্রসঙ্গে। বলেন, ‘‘এনডিএ সরকারের নিশ্চিত জয় দেখে ইন্ডি জোটের নেতাদের মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পুরোদমে তারা মোদীকে গালি দিচ্ছে। ইন্ডি জোটের দুর্নীতিবাজ লোকেরা আমার পরিবার নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। তারা বলছে, মোদীর নিজের পরিবার নেই। তাই পরিবারবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে।’’ এর পরেই মোদী বাংলায় বলেন, ‘‘ওরা জানতে চায় মোদীর পরিবার কোথায়? ওই সব ঘোর পরিবারবাদী নেতারা দেখুন, আমার দেশের এই বোনেরা যাঁরা এসেছেন, যাঁরা দেশের কোনায় কোনায় আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তাঁরাই তো মোদীর পরিবার। এটাই তো আমার পরিবার।’’
বাংলায় সভা করতে এসে রাজ্যের সকল মা-বোন তাঁর পরিবার বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘‘মোদীর শরীরের প্রতিটি অংশ, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত দেশের মাতৃশক্তির জন্য সমর্পিত। যখন মোদীর কোনও কষ্ট হয়, তখন এই মা-বোনেরা কবচ হয়ে মোদীর রক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে যান। আমার জন্য বাংলার মা, বোন, দুর্গার মতো উঠে দাঁড়ান। এখন সকল দেশবাসী নিজেকে মোদীর পরিবার বলছে। দেশের সব গরিব, কৃষক, যুবক সবাই বলছে, ম্যায় হুঁ মোদি কা পরিবার। আমি মোদীর পরিবার।’’
এই প্রসঙ্গেই তাঁর পূর্বাশ্রমের কাহিনি শোনান মোদী। বলেন, ‘‘আজ এত সংখ্যায় মা-বোনদের মধ্যে এসে জীবনের একটা ঘটনা খুব বলতে ইছে করছে। আগে কখনও বলিনি। কারও কারও মনে হতে পারে, ইন্ডি জোটের নেতারা গালি দিচ্ছে। তাই আমি এঁদের নিজের পরিবার বলছি।’’ এর পরেই প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমি অনেক ছোট বয়সে একটা ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। পরিব্রাজকের মতো দেশের কোনায় কোনায় ঘুরেছি। পকেটে একটা পয়সাও ছিল না। কিন্তু আপনাদের জেনে গর্ব হবে, আমাদের দেশের মা-বোন-পরিবার ঠিক কী রকম হন। আমার কাছে টাকাও ছিল না, সব ভাষাও জানতাম না। শুধু কাঁধে একটা ঝোলা ছিল। কিন্তু কোথাও না কোথাও কোনও না কোনও পরিবার, মা-বোনেরা জিজ্ঞাসা করতেন ‘কিছু খেয়েছ না খাওনি?’ এত বছর ঘুরেছি পকেটে পয়সা ছাড়া। কিন্তু কোনও দিন অভুক্ত থাকিনি।’’ আবেগতাড়িত মোদী আরও বলেন, ‘‘তখন আমার কোনও পরিচিতি ছিল না। কেবল এক ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যুবক ছিলাম। কিন্তু দেশের যেখানে গিয়েছি, মানুষ আমার জন্য চিন্তা করেছে। তাই আমি আজ ভারতবাসীর জন্য, মা-বোন-গরিবের ঋণ শোধ করছি। দেশের কোটি কোটি মা-বোনের ঋণ শোধ করছি।’’
তৃণমূল পাল্টা ‘মোদীর পরিবার’ নিয়ে বিজেপিকে আক্রমণ করেছে বুধবার। বারাসতের সভা শেষ হওয়ার পরে পরেই তৃণমূল দলীয় ফেসবুক পেজে তারা লেখে, ‘মোদীর পরিবারের সদস্যপদ একচেটিয়া ভাবে অপরাধী, ধর্ষক এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের জন্যই সংরক্ষিত।’’ তৃণমূল এমন দাবির চারটি কারণও লিখেছে। প্রথমত, বিজেপির সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সাংসদ ও বিধায়ক আছেন, যাঁদের নামে অপরাধের মামলা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংহ মহিলা কুস্তিগীরদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত। তৃতীয়ত, বিজেপির আইটি সেলের সদস্যেরা আইআইটি-বিএইচইউয়ের একাধিক ছাত্রছাত্রীদের ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত। চতুর্থ কারণে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা ছাড়াও নারায়ণ রাণে, অজিত পওয়ারের নাম উল্লেখ করে দাবি করেছে, এঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির মামলা রয়েছে!