রাহুল গান্ধী। ছবি: পিটিআই।
রাহুল গান্ধীকে লোকসভার বিরোধী দলনেতা হিসেবে দেখতে চাইছে কংগ্রেস তথা বিরোধী শিবিরের বড় অংশ। সূত্রের খবর, অধিকাংশ কংগ্রেস নেতা মনে করছেন, লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা হিসেবে রাহুলেরই বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব নেওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে তিনি ২০২৯-এর লোকসভা নির্বাচনে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পারবেন। যদিও রাহুল তাতে রাজি হবেন কি না, সেটিই এখন মূল প্রশ্ন।
কংগ্রেস সূত্রের খবর, বুধবার দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের বাড়িতে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের নেতাদের জমায়েতে এই প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে এ বিষয়ে বৈঠকে কোনও আলোচনা হয়নি। কিন্তু বিরোধী নেতাদের নিজেদের মধ্যে ঘরোয়া আড্ডায় অনেকেই মত দিয়েছেন যে, রাহুলেরই বিরোধী দলনেতা হওয়া উচিত। বৈঠকের আগে উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনার নেতা সঞ্জয় রাউত বলেন, ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সরকার হলে, সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে যদি রাহুল রাজি হন, তাতেও তাঁদের আপত্তি থাকবে না।
এ দিন প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা মোদী সরকারের বিরুদ্ধে রাহুলের লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আবেগঘন বিবৃতি দিয়েছেন। তার পরে রাহুলের বিরোধী দলনেতা হওয়া নিয়ে জল্পনা আরও বেড়েছে। রাহুল-ঘনিষ্ঠ এক কংগ্রেস নেতার মন্তব্য, ‘‘আগে হলে রাহুল হয়তো রাজি হতেন না। কিন্তু এখন তিনি বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব নিতে পারেন। এ বারের লোকসভা ভোটে মানুষ নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ব, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, বিদ্বেষের রাজনীতির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। বিজেপি জিতলেও রাহুল তাঁর ভারত জোড়ো যাত্রা থেকে মোদীর বিদ্বেষের রাজনীতির বিরুদ্ধে, সংবিধান বাঁচানোর পক্ষে লড়াই শুরু করেছিলেন। ভোটে মানুষ তাতে সাড়া দিয়েছেন।’’ সেই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে রাহুল এ বার মোদীর বিরুদ্ধে আরও আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিতে পারেন বলেই ওই নেতার দাবি।
কংগ্রেস নেতাদের মতে, বিরোধী দলনেতাকে সিবিআই প্রধান, লোকপাল, মুখ্য ভিজিল্যান্স কমিশনার নিয়োগের বাছাই কমিটির বৈঠকে যেতে হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও প্রধান বিচারপতি থাকেন। রাহুল বিরোধী দলনেতা হলে মোদীর মুখোমুখি বসে নিজের মতামত বা আপত্তি জানাতে পারবেন। তবে উল্টো দিকে কংগ্রেসের আর একটি অংশের মত হল, রাহুল কোনওদিনই সারাদিন সংসদে বসে থাকার ব্যক্তি নন। ফলে তাঁর পক্ষে বিরোধী দলনেতার ভূমিকা পালন করা কঠিন। সংসদে বসে থাকার বদলে তিনি ভারত জোড়ো যাত্রার মতো প্রচারে বা সংগঠন মজবুত করার কাজে বেশি আগ্রহী। এ বারের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের আগের বারের তুলনায় ৪৭টি আসন বেড়েছে। ভোটের হারও বেড়েছে। কিন্তু ৯৯টি আসন জিতলেও বহু রাজ্যে কংগ্রেসের সাংগঠনিক দুর্বলতা স্পষ্ট।
মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, গুজরাত মিলিয়ে ৬৬টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে কংগ্রেস মাত্র ২টি আসন জিতেছে। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস কোনও আসন জেতেনি। ছত্তীসগঢ়, গুজরাতে কংগ্রেস মাত্র ১টি করে আসন জিতেছে। হিমাচল প্রদেশে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলেও কোনও আসন জিততে পারেনি। কর্নাটক, তেলঙ্গানা—কংগ্রেস শাসিত অন্য দুই রাজ্যেও কংগ্রেসের ফল ভাল হয়নি। এই রাজ্যগুলিতে কংগ্রেসের ভাল হলে ‘ইন্ডিয়া’ সরকার গঠনের জায়গায় চলে যেতে পারত। উত্তরপ্রদেশে অপ্রত্যাশিত ভাবে ছ’টি আসন এবং তামিলনাড়ুতে ৯টি আসন জিতলেও, তার পিছনে মূলত সমাজবাদী পার্টি, ডিএমকে-র বদান্যতা বলে কংগ্রেস নেতারা মেনে নিচ্ছেন।
২০১৪ ও ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পরে লোকসভায় কোনও বিরোধী দলনেতাই ছিলেন না। কারণ, কংগ্রেস বৃহত্তম বিরোধী দল হলেও লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা বিরোধী দলনেতার তকমা পাননি। কারণ, তার জন্য কংগ্রেসকে লোকসভার মোট আসনের ১০ শতাংশ আসন জিততে হত। প্রথম মোদী সরকারে মল্লিকার্জুন খড়্গে ও দ্বিতীয় মোদী সরকারে অধীর চৌধুরী বৃহত্তম বিরোধী দলের নেতার পদে ছিলেন।
এ বার অধীর হেরে গিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে মধ্যপ্রদেশে দিগ্বিজয় সিংহ, ছত্তীসগঢ়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বঘেল, রাজস্থানের সি পি জোশী, হিমাচলে আনন্দ শর্মার মতো প্রবীণ নেতারা হেরে গিয়েছেন। মধ্যপ্রদেশে কমল নাথের ছেলে নকুল নাথ, রাজস্থানে অশোক গহলৌতের ছেলে বৈভব গহলৌত, হিমাচলের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্র সিংহের ছেলে বিক্রম আদিত্য সিংহ হেরে গিয়েছেন। রাজবব্বর, কান্তিলাল ভুরিয়ার মতো পরিচিতও মুখও হেরেছেন।
ফলে, রাহুল রাজি না হলে লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা তথা বিরোধী দলনেতা কে হবেন, সেই প্রশ্নও উঠছে। পুরনো সাংসদদের মধ্যে শশী তারুর, মণীশ তিওয়ারি এবং কে সি বেণুগোপাল লোকসভায় জিতে এসেছেন। বেণুগোপাল রাহুলের সব থেকে আস্থাভাজন হলেও, তিনি এখন কংগ্রেসের সাংগঠনিক সম্পাদক। ফলে তাঁকে লোকসভার বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব দিলে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে সরানোর দাবি উঠতে পারে। গত লোকসভায় কংগ্রেসের উপ-দলনেতা গৌরব গগৈও ‘ডার্ক হর্স’ হিসেবে সবাইকে পিছনে ফেলে দিতে পারেন। বিশেষত কংগ্রেস এ বার অসমে তিনটি আসন জেতা ছাড়াও উত্তর-পূর্বের মণিপুর, নাগাল্যান্ডে সব আসন জিতেছে। অমেঠীতে স্মৃতি ইরাণিকে হারিয়ে আসা কিশোরীলাল শর্মা আজ ১০ জনপথে এসে সনিয়া, রাহুল, প্রিয়ঙ্কার সঙ্গে দেখা করেছেন। তবে প্রথম বারের সাংসদ কিশোরীলালকে বিরোধী দলনেতার দৌড়ে কেউ রাখছেন না।
আরও একটি প্রশ্ন কংগ্রেসের অন্দরে রয়েছে। তা হল, রাহুল দু’টি আসন জেতার পরে রায়বরেলী না ওয়েনাড়, কোন আসন থেকে ইস্তফা দেবেন? কংগ্রেসের সিংহভাগ নেতা মনে করছেন, রাহুল রায়বরেলীর সাংসদ থেকে ওয়েনাড়ের সাংসদ হিসেবে ইস্তফা দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে যে ভাবে অমেঠী-রায়বরেলীতে জয়ের পিছনে প্রিয়ঙ্কার ভূমিকার প্রশংসা করা হচ্ছে, তাতে উপনির্বাচনে তাঁর ময়দানে নামার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।