পদ্মশিবিরের অন্দরের আলোচনায় প্রাথমিক ভাবে পাঁচ ‘ভিলেন’ খোঁজার কাজ শুরু হয়েছে। —ফাইল চিত্র।
বাংলায় সাংসদ সংখ্যা ২ থেকে ১৮ হতেই রাজ্যে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখেছিল বিজেপি। ২০২১ সালে নীলবাড়ির লড়াইয়ে সে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এর পরে বিজেপির স্বপ্ন ছিল দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে সাফল্য নিয়ে। অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন থেকে সিএএ কার্যকর হওয়ার মতো ঘটনা, তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা নানা দুর্নীতির অভিযোগ ও তদন্ত রাজ্যে পদ্মের জমি আরও মজবুত করবে বলেই অঙ্ক কষেছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তাতে ভর করেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কমপক্ষে ৩০ আসন জয়ের লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও একই অঙ্কে ভরসা রেখে বাংলায় দল সবচেয়ে ভাল ফল করবে বলে দাবি করেছিলেন। বিভিন্ন বুথফেরত সমীক্ষা দেখার পরে আরও আশাবাদী হয়ে ওঠা বিজেপির তিন বছরের মধ্যে দ্বিতীয় বার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে মঙ্গলবার। আর গণনা চলতে চলতেই শুরু হয়ে যায় হারের ‘দায়’ চাপানো। ফলপ্রকাশের পরদিন তা আরও জোরালো হয়েছে।
অনেকেই মনে করছেন, ভোটে ‘নেতৃত্ব’ দেওযার মতো উপযুক্ত নেতা পাওয়া যায়নি। যাঁদের উপরে ভার ছিল, তাঁদের কেউ অনভিজ্ঞ, কেউ ভোটের রাজনীতিতে অতটা দড় নন, আবার কেউ ‘দ্বিতীয় সারির নেতা’। অনেকের প্রশ্ন, রাজ্যে চার জন কেন্দ্রীয় ‘পর্যবেক্ষক’ থাকলেও ফল এত খারাপ কেন? কিন্তু তার পাল্টা অনেকে বলছেন, বিজেপিতে ‘পর্যবেক্ষক প্রথা’ আগেই ব্যর্থ হয়েছে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তা পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত। ফলে, তাতে খুব একটা লাভ হত না।
বিজেপির অন্দরে এখন অনেক আলোচনা। সেই আলোচনায় সকলেই অপরপক্ষকে কাঠগড়ায় তুলছেন। আবার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ত্রুটিও দেখাচ্ছেন অনেকে। তবে রাজ্য বিজেপির পক্ষে প্রকাশ্যে যা দাবি করা হচ্ছে, তাতে বাংলার ফল আদৌ দলের কাছে ‘বিপর্যয়’ নয়। রাজ্যের প্রধান মুখপাত্র তথা রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘আমরা নেতৃত্বের দেওয়া লক্ষ্যপূরণ করতে পারিনি ঠিকই। তবে এটা কখনওই বিপর্যয় নয়। আশা ছিল, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি অনুকূল ছিল না। বিধানসভা নির্বাচনের পরে যে সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে যতটা লড়াই দেওয়ার দল দিয়েছে। সেই মতোই ফল হয়েছে।’’ একই সঙ্গে এই ফল নিয়ে দলে বিচার-বিশ্লেষণ হবে জানিয়ে শমীক বলেন, ‘‘আমরা কারণ খুঁজব তো বটেই। তবে এখন ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাস থেকে দলের কর্মীদের এবং জেলায় জেলায় দলীয় দফতর রক্ষা করাই আমাদের প্রধান কাজ।’’
দলের একটা অংশ হারের অনেকটা ‘দায়’ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর উপরে চাপাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কেন শুভেন্দুর কথার উপরে বেশি ভরসা করেছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে বিজেপির অন্দরে। ইতিমধ্যেই পরাজিত প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ তাঁকে ‘কাঠি’ করে অন্য আসনে পাঠানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন। দিলীপের লক্ষ্য যে শুভেন্দু, তা রাজ্য বিজেপির সকলেই জানেন। বিষ্ণুপুর আসনে জয়ী সৌমিত্র খাঁ রাজ্য স্তরে ‘অভিজ্ঞ’ নেতার অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। তৃণমূলের সঙ্গে কারও কারও বোঝাপড়া হয়ে থাকতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন। নামোল্লেখ না করলেও রাজনীতিতে আসার কয়েক বছরের মধ্যেই রাজ্য সভাপতি হয়ে যাওয়া সুকান্ত মজুমদারই যে সৌমিত্রের প্রধান লক্ষ্য, সেটা স্পষ্ট।
শুভেন্দু এই সংক্রান্ত কোনও মন্তব্য কোথাও করেননি। তবে সুকান্ত এই পরাজয়ের পিছনে রাজ্য নেতৃত্বের ‘ত্রুটি’ রয়েছে কি না, তা যাচাই করতে চান। তিনি বলেন, ‘‘সত্যিই তো, এত খারাপ ফল আমাদের হওয়ার কথা ছিল না! হয়েছে যখন, তখন নিশ্চয়ই কিছু ত্রুটি ছিল। সেটা আমি অস্বীকার করতে পারি না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই ত্রুটি খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে নিতে হবে।’’ একই সঙ্গে সুকান্ত বলেন, ‘‘ফল তো শুধু বাংলায় খারাপ হয়নি, গোটা দেশেই। সুতরাং কোথায় ত্রুটি, তা বুঝতে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে।’’
বিজেপিতে এমন সব প্রকাশ্য দাবির আড়ালে অন্য আলোচনাও রয়েছে। আর সেই আলোচনায় কাঠগড়ায় যেমন রাজ্য নেতৃত্ব, তেমন কেন্দ্রীয় নেতারাও। সব মিলিয়ে পদ্মশিবিরের অন্দরের আলোচনায় প্রাথমিক ভাবে পাঁচ ‘ভিলেন’ খোঁজার কাজও হয়ে গিয়েছে। বলা হচ্ছে, জিততে পারত এমন চারটি এবং আগে জেতা আটটি আসনে দল হেরে গিয়েছে এই সব কারণেই।
প্রথম ভিলেন: রাজ্যের মানুষের সঙ্গে বাংলার নেতাদের দূরত্ব। মানুষ কী চায়, সেটা বোঝায় খামতি ছিল। প্রচারে এমন এমন বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে, যার সঙ্গে মানুষের প্রতিদিনের জীবনের যোগ কম। অন্য দিকে, তৃণমূল সেই কাজটাই করে ভোটে বাজিমাত করেছে। ‘বিকশিত ভারত’, ‘মোদীর গ্যারান্টি’, ‘সূর্যোদয় যোজনা’-র মতো ভারী ভারী বক্তব্যের চেয়ে কী করে সংসার চালাতে সুবিধা হবে, সেই দিকে জোর দেওয়া উচিত ছিল।
দ্বিতীয় ভিলেন: কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভূমিকা। রাজ্য বিজেপির অনেকেই বলছেন, বাংলায় কী ভাবে ভোট হবে, কোন কোন বিষয়ে প্রচারে জোর দেওয়া হবে, সবই ঠিক করে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। আর রাজ্য নেতারা ‘হ্যাঁ’-তে ‘হ্যাঁ’ মিলিয়েছেন। এই প্রসঙ্গেই উঠছে দিলীপের আসনবদল প্রসঙ্গ। একই সঙ্গে বলা হচ্ছে, আগে দিলীপ যে ভাবে কেন্দ্রীয় নেতাদের সব কথা মেনে না নিয়ে পাল্টা মতামত জানাতেন, তেমন এখন কেউ করেন না। এমনকি, এমন হারের পরেও রাজ্য বিজেপির মতামত শোনা হবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছেন নেতাদের একাংশ। বর্তমান বিজেপির যা সংস্কৃতি, তাতে অমিত শাহ যে কারণ বলবেন, যে পথে হাঁটতে বলবেন, সেটাই শিরোধার্য করে নিতে হবে। রাজ্য নেতাদের ‘না’ বলার নিয়ম নেই মোদী-শাহের বিজেপিতে।
তৃতীয় ভিলেন: সাংগঠনিক দুর্বলতা। ২০১৯ সালে বিজেপি দুর্বলতা সত্বেও ভাল ফল করেছিল মূলত প্রবল মোদী হাওয়ায়। এ বার সেই হাওয়া না থাকাতেই সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। তাতে সরাসরি অভিযোগের মুখে সংগঠন সামলানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। বিধানসভা নির্বাচনের পরে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাঁদের অনেককে রেখে দেওয়া এবং অনেক যোগ্যকে বাদ দেওয়াও হারের বড় কারণ বলে মনে করছেন কেউ কেউ। বিজেপির ওই অংশ এমনটাও দাবি করছে যে, দলের নেতাদের একাংশের ‘ঔদ্ধত্য’ বেড়ে যাওয়া, সরাসরি উচ্চপদে আসীন হয়ে যাওয়া বিজেপির সামগ্রিক ক্ষতি করেছে। যার প্রভাব পড়েছে ভোটের ফলে।
চতুর্থ ভিলেন: সঙ্ঘ পরিবার। দলের নেতাদের একাংশের দাবি, ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধন হয়। তার এক মাস আগে থেকেই রাজ্যে সেই কর্মসূচি সফল করার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। উদ্বোধনের পরে বাংলা থেকে ট্রেন ভরে ভরে দলীয় কর্মীদের অযোধ্যায় নিয়ে যাওয়া হয়। এখন মনে করা হচ্ছে, সেই সময়ে দল ভোটার তালিকা সংশোধন বা বুথ স্তরে সংগঠন বিস্তারে সময় দিলে ভোটে লাভ মিলত। দলের এক নেতার দাবি, ‘‘রামলালা দর্শনের যে আয়োজন করা হয়েছিল, তার ফল ভোটে মেলেনি। যাঁরা গিয়েছিলেন তাঁরা এমনিতেই বিজেপির ভোটার। নতুন ভোটার টানার জন্য বাংলায় রামনাম যে ফল দেবে না, সেটা বোঝেননি বিজেপি-সহ সঙ্ঘ পরিবারের নেতারা।’’
পঞ্চম ভিলেন: প্রার্থী বাছাই। বিজেপির নিয়ম অনুযায়ী রাজ্য নেতারা প্রস্তাব করলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এ বারে একগুচ্ছ বাইরের লোককে টিকিট দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে কৃষ্ণনগরে ‘রানিমা’ অমৃতা রায় যেমন রয়েছেন, তেমনই সন্দেশখালির গৃহবধূ রেখা পাত্রও রয়েছেন। দলের একাংশের বক্তব্য, এঁদের প্রার্থী না করে দলের নেতাদের লড়তে দিলে মানুষের সমর্থনের আগে দলের কর্মীদের সমর্থন বেশি মিলত। যাতে জয়ের সম্ভাবনা বেশি ছিল। প্রার্থী বাছাই করতে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করা হয়েছে বলেও অভিযোগ। সেই সঙ্গে কেউ কেউ এমনও বলছেন যে, ২০২১ সালে তৃণমূল থেকে একঝাঁক নেতাকে নিয়ে যে ভুল হয়েছিল, সেটা আবার করা ঠিক হয়নি। রাজ্য স্তরের এক নেতার কথায়, ‘‘কলকাতা উত্তরে সদ্য দলে আসা তাপস রায়ের বদলে যদি দলের কোনও নেতা হারতেন, তাতে কী ক্ষতি হত? অন্তত বিজেপিতে এটা প্রতিষ্ঠিত হত যে, এই দলে নীচ থেকে উপরে উঠতে হয়। দলের হয়ে কাজ করলে পুরস্কার পাওয়া যায়।’’ ওই নেতারই বক্তব্য, ‘‘ভোটের ঠিক আগে আগে অতীতে দল থেকে চলে যাওয়া অর্জুন সিংহকে ফিরিয়ে নিয়ে প্রার্থী করা ঠিক হয়নি। এতে দল শুধু ব্যারাকপুরেই হারেনি, অন্য আসনেও এর প্রভাব পড়েছে। বারংবার দলবদলুদের যে মানুষ পছন্দ করে না, সে শিক্ষা কি বিধানসভা ভোট থেকেও নেননি নেতারা?’’