ইঞ্জিনিয়ার সংগৃহীত ছবি
গত ১৫ সেপ্টেম্বর ছিল জাতীয় ইঞ্জিনিয়ার দিবস। দেশের উন্নতিতে প্রযুক্তিবিদদের অবদানকে স্বীকৃতি জানাতেই এই দিবসের উদ্যাপন। সভ্যতার অগ্রগতিতে প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও তার প্রয়োগের জন্য বিশেষজ্ঞ প্রযুক্তিবিদদের উপস্থিতি অপরিহার্য। প্রাচীন কালের পিরামিড নির্মাণ থেকে শুরু করে আজকের মাইক্রোচিপ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এ কথা সর্বজনীন ভাবে সত্য।
এখন প্রশ্ন হল, ইঞ্জিনিয়ার হতে গেলে ঠিক কী প্রয়োজন? মনে রাখা দরকার, একটি সেফটিপিন, ছোটখাটো যন্ত্রপাতি, বিভিন্ন যান্ত্রিক পরিষেবা, শিল্প, স্মার্টফোন, কম্পিউটার এমনকি সড়কপথ, সেতু, রাস্তা, বাড়ি পর্যন্ত সব কিছুই প্রযুক্তিবিদদের সৃষ্টি। তাই যাঁরা ইঞ্জিনিয়ার হতে চান, তাঁরা এই কেরিয়ার নিঃসন্দেহে বেছে নিয়ে মানুষের জীবনকে আরও সহজ করে তুলতে পারেন।
ইঞ্জিনিয়ারদের ভূমিকা
ইঞ্জিনিয়াররা বিভিন্ন যন্ত্রের নকশা অঙ্কন, নির্মাণ ও পরিকল্পনার মতো কাজগুলি করে থাকেন। সমাজের বিবিধ কঠিন সমস্যার সমাধান করতেও ইঞ্জিনিয়ারদের দরকার পড়ে, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পানীয় জল সরবরাহ থেকে, গৃহনির্মাণ, মহাকাশযান তৈরি থেকে কম্পিউটারের খুঁটিনাটি তাঁদের কাজের মধ্যে পড়ে। শুধু নির্মাণ নয়, নির্মিত বিষয়গুলির রক্ষণাবেক্ষণেও ইঞ্জিনিয়ারদেরই প্রয়োজন পড়ে। কোনও একটি যন্ত্র বিকল হলে বা কোনও সফটওয়্যারে সমস্যা দেখা দিলে, সেগুলি একজন ইঞ্জিনিয়ারকেই চিহ্নিত করে ঠিক করে দিতে হয়।
এ বার জেনে নেওয়া যাক, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ কোন কোন বিভাগ রয়েছে?
১. ইলেকট্রিক্যাল- এই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ইঞ্জিনিয়াররা বিভিন্ন বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নির্মাণ এবং সেই সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান করেন।
২. মেকানিক্যাল- এই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ইঞ্জিনিয়াররা বিভিন্ন যন্ত্রের নকশা বানন বা বিভিন্ন যন্ত্রাংশ উদ্ভাবন করেন।
৩. কেমিক্যাল- এই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ইঞ্জিনিয়াররা পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ, জ্বালানি এবং অন্যান্য উপাদানের কাঠামো এবং সেগুলি প্রস্তুত করার উপায়গুলি নির্ণয় করেন।
৪. মেরিন- এই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ইঞ্জিনিয়াররা বিভিন্ন জলযানে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির নির্মাণ, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকেন।
৫. সফটওয়্যার- এই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ইঞ্জিনিয়াররা কম্পিউটার সফটওয়্যার সংক্রান্ত কাজ করেন।
ইঞ্জিনিয়ারিং-এর আরও অনেক শাখা রয়েছে, যেমন-- ইলেকট্রনিক্স, পাওয়ার, এনার্জি, ফ্লাইট, লোকোমোটিভ, ন্যানো সিস্টেম, নিউক্লিয়ার, পেট্রোলিয়াম, পলিমার, রোবোটিক্স, সিভিল, প্রোডাকশন, ইন্সট্রুমেন্টেশন, টেক্সটাইল, জিওথার্মাল, এগ্রিকালচারাল, এরোস্পেস, উইন্ড, ওয়াটার, সেলস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইত্যাদি।
সমস্ত শাখার ক্ষেত্রেই বিষয়ভিত্তিক তত্ত্বকে বাস্তবিক ও কারিগরি রূপ দেওয়া হয়ে থাকে, যেমন-মেকানিক্সের বিভিন্ন তত্ত্বকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা সমস্যার সমাধানের জন্য যে বাস্তবিক রূপ দেন সেটিই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে কোন কোন চাকরিতে নিয়োগ হতে পারে :
ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর করে শিক্ষার্থীরা সরকারি বা বেসরকারি চাকরি পেতে পারেন, জনসেবামূলক কাজ করতে আগ্রহী হলে ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন দ্বারা আয়োজিত 'ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস' পরীক্ষায় বসতে পারেন অথবা পরীক্ষা দিয়ে বিভিন্ন রাজ্য সরকারি দফতরে চাকরি করতে পারেন। দেশের স্বাধীনতার পরে বড় শিল্প গড়ে ওঠায়, সেই সমস্ত সরকারি বড় শিল্প সংস্থাগুলিতে ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগ করা হত। এর পর অর্থনীতির উদারীকরণ এবং বেসরকারিকরণের পর ভারতবর্ষে প্রচুর বেসরকারি কোম্পানি গড়ে ওঠে এবং সেই সমস্ত কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ারদের বিপুল পরিমাণে নিয়োগ করা হয়। এ ছাড়াও যাঁরা উচ্চশিক্ষায় গিয়ে গবেষনা করতে চান ও শিক্ষকতা করতে চান, তাঁদেরও যথাযথ যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হয়।
কোন বিভাগের বেশি চাহিদা রয়েছে?
সাম্প্রতিক কালে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং,অটোমেশন ও রোবোটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রিকালচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং, অল্টারনেটিভ এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চাহিদা তুলনামূলক ভাবে বেশি।
আবার বেতনের ভিত্তিতে দেখতে গেলে, কম্পিউটার সায়েন্স, মেকানিক্যাল, ইলেক্ট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স ও কমিউনিকেশন, কেমিক্যাল ও ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চাকরিতে সবচেয়ে বেশি বেতন পাচ্ছেন ইঞ্জিনিয়াররা।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে চাকরি ক্ষেত্র কেমন হয়, সে সম্পর্কিত আরও কিছু খুঁটিনাটি তথ্য-
১. ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে চাকরির সুবাদে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ থাকে।
২. ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চাকরির ক্ষেত্রে আংশিক সময়ের কাজের সুযোগ কম, প্রায় সমস্ত কাজই পূর্ণ সময়ের হয়ে থাকে।
৩. কর্মক্ষেত্রটি কোনও অফিস হবে না ফিল্ড হবে, তা নির্ভর করছে কোন বিভাগের চাকরি-- তার উপর। যেমন -একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার অফিসে বসে কাজ করেন কিন্তু একজন এগ্রিকালচারাল ইঞ্জিনিয়ার ফিল্ডে গিয়ে কাজ করেন।
৪. ইঞ্জিনিয়ারদের মোটমাট দিনে ১০ ঘন্টা কাজের সময় বরাদ্দ থাকে।
৫. ডেডলাইনে কাজ জমা করার ব্যাপার থাকায় ইঞ্জিনিয়ারদের অনেক ক্ষেত্রেই সাপ্তাহিক ৪০-৪৫ ঘন্টা কাজ করতে হয়।
শিক্ষাগত যোগ্যতা
ইঞ্জিনিয়ার হতে গেলে দ্বাদশ শ্রেণিতে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও অঙ্ক নিয়ে ৫০ শতাংশ নম্বর পেয়ে কোনও স্বীকৃত বোর্ড থেকে পাশ করতে হবে।
এন্ট্রান্স পরীক্ষা
দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করে এর পর বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির জন্য জয়েন্ট এন্ট্রাস মেন্স পরীক্ষা, জয়েন্ট এন্ট্রাস অ্যাডভান্সড পরীক্ষা, ভিআইটিইইই এবং বিটস্যাট পরীক্ষায় বসতে পারেন ছাত্রছাত্রীরা।
ডিগ্রি
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ছাত্রছাত্রীরা স্নাতকে বিটেক বা বিই ডিগ্রি অর্জন করতে পারেন।
স্নাতক হওয়ার পর এম টেক বা পি এইচডি ডিগ্রিও অর্জন করতে পারেন।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য ভারতবর্ষের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় -
১.আইআইটি মাদ্রাজ
২. আইআইটি দিল্লি
৩. আইআইটি বোম্বে
৪. আইআইটি কানপুর
৫. আইআইটি খড়্গপুর
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়-
১.আইআইটি খড়্গপুর
২. যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
৩. এনএইটি দুর্গাপুর
৪. আইআইইএসটি শিবপুর
৫. ড: বি সি রায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, দুর্গাপুর।
কলেজ বা কোর্স নির্বাচনের ক্ষেত্রে কী কী বিষয় মাথায় রাখতে হবে :
১. যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এআইসিটিই দ্বারা স্বীকৃত ও ইউজিসির দ্বারা অনুমোদিত, শুধু মাত্র সেই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজই ভর্তির সময় নির্বাচন করতে হবে।
২. যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ন্যাক ও এনবিএ দ্বারা প্রত্যয়িত, সেই সব কলেজই ভর্তির জন্য নির্বাচন করতে হবে।৩. যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ডিগ্রি কোর্স শেষ হওয়ার পর চাকরির জন্য প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়া রয়েছে, সেই কলেজগুলি শিক্ষার্থীদের নির্বাচন করা উচিত, পড়াশোনা শেষ করে তাড়াতাড়ি নিজেদের চাকরি নিশ্চিত করার জন্য।
৪. বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে (ফেসবুক, টুইটার, লিঙ্কডিন ইত্যাদিতে) দেখে নিতে হবে সংশ্লিষ্ট কলেজগুলির কেমন সুনাম বা দুর্নাম আছে।
তাই আপনার স্বপ্নপূরণের পথে পা বাড়াতে গেলে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করে এই পেশাকে বেছে নিন এবং দেশের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখুন।