করোনাভাইরাস ঠেকাতে যে যুদ্ধ চলছে, তার তুল্য আমরা কিছু দেখিনি জীবৎকালে, নিঃসন্দেহে। প্রায় ভুলতে চলা ১২৩ বছরের পুরনো মহামারি আইনকে ধুলোটুলো ঝেড়ে সক্রিয় করা হয়েছে। সর্বব্যাপী এই সরকারি সক্রিয়তা দেখে রীতিমতো চিন্তিত ডেঙ্গির ভাইরাস আর ম্যালেরিয়ার জীবাণুরা। অনুকূল মেঘলা আবহাওয়া পেয়ে মশককুলের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে দ্রুত। ২৪ ঘণ্টা তারা কানের কাছে ভোঁ ভোঁ করে চলেছে। করোনা নিয়ে কড়াকড়ির জেরে অনেক সতর্কতা জারি হলেও মশককুলের অনিয়ন্ত্রিত বংশবৃদ্ধি থেমে থাকেনি। সব খারাপ খবরের মধ্যে ডেঙ্গি ভাইরাস আর ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্লাসমোডিয়াম ভাইভাক্স ও প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরামদের কাছে এটাই ভাল খবর। এডিস ইজিপ্টাই আর অ্যানোফিলিস স্টিফেনসাই মশার বংশ যত বাড়বে, ততই এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের শরীরে চলে যাবে তারা।
এ রাজ্যে এত দিন বেশ ছিল ওই ওরা। রাজ্য সরকারের নির্দেশে অনেক ক্ষেত্রেই রোগ থেকেছে চাপা। রোগ হলেও জীবাণুটা কী তা বলা যাবে না। মারা গেলে ডেথ সার্টিফিকেটেও লেখা যাবে না ওই রোগের নাম। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে মশা মারার তেলের জোগান প্রয়োজনের থেকে অনেক কমে যাওয়া সত্ত্বেও, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কাছে রোগের তথ্য পাঠানো যাবে না— কয়েক বছর ধরে এটাই রাজ্য সরকারের নীতি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে কিন্তু অন্য রকম। মানুষকে রোগ চেপে রাখতে নিষেধ করছে সরকারও। শুধু তা-ই নয়, কেউ রোগ লুকোলে তাকে জোর করে হাসপাতালে ভর্তি করানোর নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। এই নির্দেশিকা ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রেও বলবৎ থাকবে কি না, তা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত ওই রোগের জীবাণুরা। সে ক্ষেত্রে আক্রান্তের ঠিক সংখ্যাটা যেমন জানা যাবে, তেমনই রোগ প্রতিরোধে এখনকার মতো কড়া হবে রাজ্য। রোগের দাপট ঠিক কতটা সেটা ঠিক ভাবে জানা গেলেই, সেই রোগ প্রতিরোধের ঠিক পরিকল্পনা করা সম্ভব। এটাই জনস্বাস্থ্যের গোড়ার কথা। ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়ার বেলায় তা মানা হলে ঠান্ডা কমার সঙ্গে সঙ্গে মশাদের এমন বাড়বাড়ন্ত হত কি?
আপাতত মশা মারা অভিযানে টান পড়েছে। আর এটাই যে তাদের সক্রিয় হওয়ার সেরা সময়, সেটা বুঝে নিয়ে তৈরি হচ্ছে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়ার জীবাণুরা। হাজারে হাজারে নতুন মশা জন্মাচ্ছে প্রতি দিন। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে মানুষের বাড়িতে, দোকানে, বাজারে। স্যানিটাইজ়ার দিয়ে ঘন ঘন হাত ধুয়ে, নাকে-মুখে মুখোশ লাগিয়ে, বাড়িতে বসে থেকে করোনার মোকাবিলা করা সম্ভব। কারণ তার ভাইরাসের মূল বাহক আক্রান্ত মানুষ। কিন্তু ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, এনসেফ্যালাইটিসে জীবাণু আর মানুষের মধ্যে আছে এক বাহক। মশা। তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কড়া দাওয়াই খুঁজে পাচ্ছে না রাজ্য সরকার। করোনা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) যে নির্দেশিকা তৈরি করেছে তার ভিত্তিটা কী? মাস চারেক আগে যখন চিনে রোগটা প্রথম ধরা পড়ল, তখন তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারেননি হু-র বিশেষজ্ঞরা। এর পরে কোথায় কোথায় কত লোকের মধ্যে রোগটা ছড়িয়েছে, কী ভাবে ছড়িয়েছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য হু সংগ্রহ করল আক্রান্ত দেশগুলির কাছ থেকে। সংক্রমণের উৎস, সংক্রমণের মাধ্যম, কী ভাবে রোগটা সেরে যাচ্ছে— এ সব তথ্য নথিভুক্ত করল তারা। তার পরে তৈরি হল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কর্মসূচি। দেশে দেশে পৌঁছে গেল হু-র নির্দেশিকা। হু জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কিন্তু এ বারই প্রথম নয়। তবে এ বার ভাইরাস নিজের চরিত্র বদলে ফেলায় তাকে চিনতে কিছুটা দেরি হয়েছে। নানা দেশের আক্রান্ত মানুষের নমুনা নিয়ে হু দেখেছে— একটি নয়, একাধিক নতুন প্রজাতির করোনাভাইরাস হানা দিয়েছে।
আরও পড়ুন: গোষ্ঠী প্রতিরোধ কি সত্যিই কাজ করতে পারে, বিরাট প্রশ্ন এখন
হয়তো পরের বছর করোনাভাইরাসের চরিত্র ফের বদলে যাবে, আক্রান্ত দেশগুলির তথ্য নিয়ে নতুন নির্দেশিকা তৈরি করা হবে। এই ভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে নানা তথ্য নিয়ে ডেঙ্গি মোকাবিলার নির্দেশিকাও এক সময় তৈরি করেছিল হু। তার পর ডেঙ্গির চরিত্র বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে রোগের উপসর্গ বদলেছে। এক-এক দেশে এক-এক ধরনের ডেঙ্গি ভাইরাস ছড়িয়েছে। সেই তথ্য দেশগুলি পাঠিয়েছে হু-র কাছে। নান বিভ্রান্তি সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশের জন্য বিভিন্ন নির্দেশিকা তৈরি করেছে হু। ঠিক তথ্য পাওয়াতেই তা সম্ভব হয়েছে। সঠিক তথ্য রোগদমনের জন্য কতটা জরুরি, এর থেকে স্পষ্ট।
আরও পড়ুন: এই অর্থনীতি যেন কাক্কেশ্বর কুচকুচের হিসেবনিকেশ
এ বার থেকে তা হলে আশা করা যায় ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া আর অজানা জ্বরেরও ঠিক তথ্য রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রককে দেবে। তা যাবে হু-র কাছে। সেই মতো হু রোগ নিরাময়ে পরামর্শ দিতে পারবে। আমাদের মতো রাজ্যে বছরের অন্তত অর্ধেক দিন আকাশ মেঘলা থাকে। যাতে ডেঙ্গির বাহক মশার বাড়বাড়ন্ত। আর ডেঙ্গিতে মূল বিপদ— এর নির্দিষ্ট প্রতিষেধক নেই, ঠিক ওষুধ নেই, মারণ-ক্ষমতা বেশি, চরিত্র বদলের প্রবণতা মারাত্মক বেশি। শুধু তা-ই নয়, ভাইরাসের সঙ্গে সঙ্গে এর বাহক এডিস ইজিপ্টাই যে ভাবে নিজের চরিত্র বদলেছে, তাতে বাড়ছে বিপদও। করোনা নিয়ে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের কড়া পদক্ষেপে নাগরিককুল এখনও অবধি খুশি। তবে কাউকে কাউকে বলতে শোনা যাচ্ছে, আহা, এই সতর্কতা যদি ডেঙ্গি দমনে থাকত!
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)