গত আড়াই মাসের মতো এমন নীল আকাশ শেষ কবে দেখেছিলাম, মনে করতে পারি না! নাক-মুখ ঢাকা না-থাকলে বোধ হয় বুক ভরে পরিষ্কার বাতাস টেনে নিতে পারতাম!
বিষকণা কমে গিয়ে বাতাস সাফসুতরো হল ঠিকই কিন্তু তা বড় সুখের সময়ে এল না। করোনার জন্য দেশজুড়ে লকডাউন হল, গাড়ির চাকায় বেড়ি পড়ল, কলকারখানার চিমনির ধোঁয়া উদগীরণ বন্ধ হল, কাজকর্ম শিকেয় তুলে ঘরে বন্দি হল মানুষ। তার পরেই কেমন ভোজবাজির মতো বদলে গেল চারপাশ। বাতাসের যে বিষ দূর করতে এত দিন এত সেমিনার, এত নীতি-প্রণয়ন করেও কাজের কাজ হয়নি, তা এই এক ধাক্কাতেই হয়ে গিয়েছে। বাতাস কেমন পরিস্রুত হয়েছে তা একটু পরিসংখ্যানে চোখ রাখলেও স্পষ্ট হতে পারে।
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য বলছে, কলকাতার বালিগঞ্জে গত ১০ মার্চ গড় বায়ুদূষণ সূচক ছিল ২৪৫। যা খারাপ হিসেবেই চিহ্নিত। ১৫ মে সেই গড় মাত্রা ছিল ৩৬! দিল্লির বায়ুদূষণও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। রাজ্যের অন্য জায়গাতেও এই দূষণের হার অনেক কমেছে। শিল্পাঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত আসানসোলে গড় দূষণের মাত্রা মে মাসে ৫০ থেকে ৭০-এর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। নদিয়ায় স্বয়ংক্রিয় বায়ুদূষণমাপক যন্ত্র নেই কিন্তু মানবচালিত (ম্যানুয়ালি অপারেটেড) যন্ত্রে গত অক্টোবরে কৃষ্ণনগর, রানাঘাটে বাতাসে দূষিত কণার মাত্রা ছিল যথাক্রমে ২৬৬ ও ৩১৪! সেখানেও ইদানিং বাতাস অনেক পরিস্রুত। যন্ত্রে মাপা না-হলেও মানুষ তা টের পাচ্ছেন।
এই বাতাসে দূষণ হ্রাসের কারণও খুবই স্পষ্ট। ডিজেল-চালিত যানবাহন বন্ধ, কলকারখানার চিমনি থেকেও ধোঁয়া বেরোচ্ছে না, বন্ধ হয়ে গিয়েছে নির্মাণকাজ। পরিবেশবিদেরা বলেন, বাতাসে দূষণের পিছনে মূল কারণ এই ক’টিই। এর পাশাপাশি রাস্তাঘাটে চায়ের দোকান, কচুরির দোকানের উনুনেও আঁচ পড়ছে না।
তবে এই লকডাউনের জেরে বাতাস যতই পরিষ্কার হোক না-কেন, সে নেহাতই সাময়িক। লকডাউনে আন-পর্ব শুরু হয়েছে। পুরোপুরি লকডাউন উঠলে বাতাস পরিষ্কার থাকবে কি না, সে প্রশ্ন নিতান্ত বাতুলতা। বরং এক ধাক্কায় ফের সব গাড়িঘোড়া হুড়মুড় করে রাস্তায় নামলে, দোকান-বাজার খুললে, কারখানা খুললে জীবনজীবিকার স্বার্থে পরিবেশের দিকে কতটা নজর থাকবে সেই প্রশ্ন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
জননীতির স্বার্থে (রাজ্য ও দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধরলে জনমোহিনী বললেও বোধ হয় ভুল হবে না), পরিবেশের স্বার্থে পেশার উপরে খড়্গহস্ত হতে চাইবে না প্রশাসন। ফলে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সে সময়ে আবারও প্রাসঙ্গিকতা হারাবে কি না, সেই আশঙ্কাও থেকে যায়।
সেই সব আশঙ্কা মাথায় রেখেও বলা যায়, আপাতত যেটুকু পরিস্রুত বাতাস মিলছে, তাই বা কম কী? কিন্তু সুস্থ পরিবেশ মানলে শুধুই কি পরিস্রুত বাতাস? গাঙ্গেয় বঙ্গের ক্ষেত্রে কিন্তু নদীর দূষণও পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। বিশেষত, নদিয়ার মতো যে সব জেলা নদীর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত সেখানে তো এই বিষয়টি আরও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। লকডাউনের জেরে নাকি নদীর দূষণ কমে গিয়েছে, গঙ্গায় শুশুক ঘুরে বেড়াচ্ছে এমন নানান গপ্প সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নদীর জলের ছবি ‘এডিট’ করে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে জনসাধারণকে। গঙ্গায় নৌকা, ভুটভুটি চলছে না, মানুষের উপদ্রবও নেই। ফলে, শুশুক এবং অন্যান্য জলজ প্রাণী শান্তিতে ঘুরতে পারতে পারে। কিন্তু তার কোনও নিশ্চিত ছবি কেউ দিতে পারেননি। জল নিস্তরঙ্গ থাকায় শ্যাওলা এবং প্ল্যাঙ্কটন বা আণুবীক্ষণিক প্রাণীর সংখ্যাও বাড়তে পারে। কিন্তু তা কি নদীর জলের গুণমান বোঝায়? নদীর জলের গুণমান আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে কি না, তার কোনও নমুনা পরীক্ষা লকডাউনের সময়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ করেনি। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদও জানিয়েছে, গঙ্গার জলের গুণমান বদলায়নি। নদিয়া জেলার ক্ষেত্রেও সে কথাই বলা চলে।
নদিয়া জেলা-সহ রাজ্যের নদী দূষণের পরিস্থিতি কী রকম, তা এক ঝলকে পর্ষদের তথ্য থেকেই স্পষ্ট হতে পারে। মার্চ মাসে রানাঘাটে চূর্ণী নদীর জলের নমুনা পরীক্ষা করে পর্ষদ যে রিপোর্ট দিয়েছিল তাতে দেখা যাচ্ছে, ফিক্যাল কলিফর্ম ব্যাক্টিরিয়ার মাত্রা প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ১ লক্ষ ৪০ হাজার! স্বাভাবিক সর্বোচ্চ মাত্রার থেকে ৫৬ গুণ বেশি! নবদ্বীপের কাছে গঙ্গায় তা প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ৪০০০। স্বাভাবিক মাত্রায় না-পৌঁছলেও কোনও মতে না পাশ করে যেতে পারে। গোবিন্দপুরে মাথাভাঙায় ফিক্যাল কলিফর্মের মাত্রা ৩ লক্ষ! চূর্ণী ও মাথাভাঙা নদীতে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা যথাক্রমে প্রতি লিটারে ১ ও ১.৩ মিলিগ্রাম। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য বলছে, এই মাত্রা ৪-এর নীচে নামলেই জলজ প্রাণীদের জীবন সঙ্কট হতে পারে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য বলছে, শান্তিপুর টাউন থেকে মাজদিয়া, এই পর্যায়ে দূষণের নিরিখে চূর্ণী স্নানের জন্যও উপযুক্ত নয়! রাজ্যে ১৭টি দূষিত নদীর যে এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে নদিয়ার তিনটি নদী জলঙ্গি, চূর্ণী এবং মাথাভাঙা রয়েছে। নদিয়া লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগনাতেও গঙ্গার পরিস্থিতি তথৈবচ। লকডাউন হলেও এই দূষণের পরিস্থিতি বদলাবে কি না, তা নিয়ে ঘোরতর সন্দিহান অনেকেই। কারণ, নদী-বিশেষজ্ঞেরা বারবারই বলেছেন, এ রাজ্যে নদীতে যত না শিল্পের বর্জ্য পড়ে তার চেয়ে বেশি পড়ে নাগরিক বর্জ্য। ফিক্যাল কলিফর্ম ব্যাক্টিরিয়া তৈরি হচ্ছে মানেই সেই জলে মলমূত্র পড়ছে। এর পাশাপাশি নদীগর্ভে জঞ্জাল ফেলা তো রয়েইছে। লকডাউনে সেই বর্জ্য কি বন্ধ হয়েছে? কোনও কোনও এলাকায় বাজারঘাটের বর্জ্য বন্ধ হলেও নিকাশি ও গৃহস্থের বর্জ্য তো মিশছেই। তা হলে?
ফিরে আসি সেই পুরনো তর্কেই। যদিও বা লকডাউনের জেরে নদীর দূষণ সামান্য হেরফের হয় তা হলেও বা কতটুকু লাভ হবে? আন-লক পর্বে তো সেই পুরনো অভ্যাস ফিরে আসবে। যেটুকুও বা কমেছিল দূষণ তা-ও আড়ে-বহরে তরতরিয়ে বাড়বে।
আদতে এই লকডাউনের জেরে বায়ু বা নদীর দূষণ হ্রাস কোনও স্থায়ী সমাধান নয়। লকডাউনের ফলে পরিবেশের অসুখ কমবেও না। তাই এই সাময়িক উন্নতি নিয়ে উৎফুল্ল হওয়ার কোনও কারণ দেখতে পাচ্ছি না।
তবে শিক্ষণীয় বিষয় অবশ্যই রয়েছে। তা হল, পরিস্থিতির কোপে আমরা অনেক কিছুই শিখতে পারি। এমনকি পরিবেশের যেটুকু স্বাস্থ্যোদ্ধার হয়েছে তা-ও ধরে রাখা যেতে পারে। তার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা এবং যথাযথ নীতি-প্রণয়ন। তা না-হলে প্রকৃতির তৈরি বিপদের সামনে ভবিষ্যতে অসহায় হয়ে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না।