ঘরে ঢুকেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন মেয়েটি। কেউ কোনও প্রশ্ন করার আগেই বলে উঠলেন, “আমাকে বাঁচান। এই কলঙ্ক আর সইতে পারছি না।” তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে শান্ত করে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যরা জানতে পারলেন, তাঁর স্তন ক্যানসার ধরা পড়ার পর স্বামী বলেছেন, এ হল পাপের শাস্তি। “ঈশ্বর জানেন আমি কোনও পাপ করিনি”, আকুতি তাঁর। অথচ কোনও অল্পশিক্ষিত, দরিদ্র পরিবারের বধূ নন তিনি। স্বামী উচ্চশিক্ষিত, বড় কোম্পানিতে কর্মরত।
স্তন ক্যানসার যেন মন্দ কাজের ফল। রোগাক্রান্ত মেয়েটি লজ্জায় সঙ্কুচিত হয়ে বাঁচবেন, এমনই যেন প্রত্যাশা করে সমাজ। এই ভ্রান্ত ধারণা ভারতে সর্বত্র। দক্ষিণ ভারতে এক গবেষক দেখেছেন, স্তন ক্যানসারে আক্রান্তেরা কেবল মৃত্যু বা রোগযন্ত্রণাকে ভয় করেন না। তাঁদের ভয়, গোটা পরিবারের অপবাদ হবে। তাই মেয়েরা রোগের পরীক্ষা এড়াতে চান। এমন ধারণা কত ব্যাপক, তা মেয়েদের কতটা বিপন্ন করে, তা সামান্যই জানা গিয়েছে। ভারতে ‘ক্যানসার’-এর অর্থ কী, শুশ্রূষা বলে লোকে কী বোঝে, তা নিয়ে বই লিখছেন সিসিলিয়া ভন হ্যালেন। তাঁকে একটি সাক্ষাৎকারে এক মহিলা বলেন, “আমি ভাল মেয়ে, ভাল বৌ। ঘর দেখেছি, সন্তান মানুষ করেছি। আমার ক্যানসার হল কেন?”
স্তন ক্যানসার নিয়ে প্রচার কম হয়নি। এ রোগ যে ছোঁয়াচে নয়, বরং রোগীকে দূরে ঠেলে রাখাই অন্যায়, সেই বার্তা নিত্যই ছড়ানো হচ্ছে। এ রোগকে পরাস্ত করে সুস্থ জীবন যাপন করছেন, তেমন দৃষ্টান্তও কম নয়। তবু ক্যানসার আক্রান্ত মেয়েদের উপর মানসিক পীড়ন চলছেই। তাঁদের দূরে সরিয়ে রাখার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয় রোগ জানাজানি হওয়ার পর থেকেই। স্তন ক্যানসারের রোগীদের নিয়ে কর্মরত এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য সুমিত্রা ভরট বলেন, “অপারেশন এবং চিকিৎসার পর রোগমুক্ত হন অনেকেই। বোঝাও যায় না যে কোনও দিন স্তন ক্যানসার হয়েছিল। তবু মেয়েদের নানা ভাবে অপদস্থ করা হয়।” যেমন, বয়স্ক মহিলাদের দূরে রাখা হয় নাতি-নাতনির থেকে। তাঁরা প্রশ্ন করেন, “বাড়ি গিয়ে নাতিটাকে একটু কোলে নিয়ে আদর করতে পারব? অসুখ হওয়ার পর থেকে আমার কাছে ওকে আসতে দেয়নি।”
ক্যানসার স্পর্শ থেকে ছড়ায় না, তা অজানা নয়। তবু শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত মহলেও স্তন ক্যানসার আক্রান্তদের এড়ানোর একটা ঝোঁক লক্ষ করা যায়। কলকাতার এক স্কুলশিক্ষিকা বললেন, “আত্মীয়-বন্ধু মহলে যে শিশুদের আগে কত আদর করেছি, অসুখ জানাজানি হওয়ার পর মায়েরা সেই শিশুদের সরিয়ে নিয়ে যেতেন আমার কাছ থেকে। জানতাম এটা অর্থহীন, কিন্তু কী বলব? চুপ করেই থাকতাম।”
এমনকি, মায়ের থেকেও দূরে রাখা হয় সন্তানকে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুলতানা বিবির অসুখ যখন ধরা পড়ে, তখন তাঁর চার সন্তান। কোলের শিশুটির বয়স চার মাস। শাশুড়ি-ননদেরা ছেলেকে দিয়ে দেন তাঁর জায়ের কাছে। ছেলেকে বুকের দুধ খাওয়ানো তো দূরের কথা, কোলে নিতেও দেওয়া হয়নি সুলতানাকে। চিকিৎসা করিয়ে সুলতানা এখন সুস্থ, কিন্তু ছেলেকে ফেরত পাননি।
আরও বড় অবিচারও কি হয় না? বছর তেইশের এক বিবাহিত তরুণীর স্তন ক্যানসার ধরা পড়ার পর শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁকে এক বছরের সন্তান-সহ বার করে দেওয়া হয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে অনেক বোঝানোর পরেও তাঁরা বোঝেননি। ওই তরুণীর ঠাঁই এখন তাঁর দিদির বাড়িতে। অনেক মেয়ে আবার চরম উপেক্ষা, পদে পদে নিষেধাজ্ঞা সইতে না পেরে নিজেরাই বাপের বাড়ি চলে যান।
ক্যানসার চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা, স্বামী বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্ত্রীর পাশে থাকেন, সব রকম সহায়তা করেন। কিন্তু পরিবারে প্রায়ই মেয়েটির আগের অবস্থান আর থাকে না। রান্নাঘরে সে না ঢুকলেই ভাল হয়, তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়। স্বামীও একান্তে চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করে যান, যৌন সম্পর্ক ফের স্বাভাবিক হতে পারে কি না। এই প্রত্যাখ্যানের মনোভাবটা পুরুষ ক্যানসার রোগীর ক্ষেত্রে সে ভাবে চোখে পড়ে না। বরং আক্রান্ত পুরুষটিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার একটা চেষ্টা থাকে পরিবারের।
কর্মক্ষেত্রেও দেখা যায়, মেয়েটির দায়িত্ব কমিয়ে তাকে কোনও হালকা কাজ দেওয়া হচ্ছে। “মুশকিল হল, আমরা মেয়েটিকে রোগমুক্ত বলে শংসাপত্র দিলেও এই ঠেলে-রাখার মনোভাব সহজে ঘোচে না”, বললেন গৌতমবাবু। “ক্যানসার রোগীর চিকিৎসা একটা চ্যালেঞ্জ, কিন্তু চিকিৎসা সফল হলেও, বেডরুম থেকে অফিস, সর্বত্র তাঁকে দূরে রাখার অভ্যাসটা দূর করাও চ্যালেঞ্জ।”
ভারতে প্রতি চার মিনিটে এক জন মেয়ের স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে, প্রতি তেরো মিনিটে এক জন মারা যায়। অল্পবয়সি মেয়েদের মধ্যে এই হার বাড়ছে। সময়মতো চিকিৎসায় অধিকাংশ মেয়েই সেরে যায়, কিন্তু প্রাণটুকু নিয়ে বাঁচাই তো সব নয়। জীবন সার্থক করতে হলে রোগ দূর করার সঙ্গে সঙ্গে রোগকে ঘিরে-থাকা কু-অভ্যাসও দূর করা চাই।