একটি মৃত্যু, কয়েকটি প্রশ্ন
Sushant Singh Rajput

কিছু কিছু পেশায় ‘বাইরের লোক’দের সফল হওয়া কঠিন কেন

এই প্রবণতা কি শুধু অভিনয় জগতে?

Advertisement

অরিজিতা দত্ত

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২০ ০২:০৫
Share:

সুশান্ত সিংহ রাজপুত

সুশান্ত সিংহ রাজপুত। বলিউডের উঠতি তারকা, প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র, তুখড় নাচিয়ে। চৌত্রিশ বছর বয়সে আত্মহত্যা করলেন রুপোলি পর্দার মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। তামাম ভারতকে হতবাক করে। মৃত্যুর পর ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের বাইরে নানান তথ্য ও তত্ত্ব আসা শুরু হল খবরের কাগজে, বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের পর্দায়। বলিউডের বড় প্রযোজনা সংস্থাগুলির দাদাগিরি, তারকা ও তারকা-পুত্রকন্যাদের একচেটিয়া রাজত্ব, বলিউডের বহিরাগত নবীন শিল্পীদের অন্যায় ভাবে আটকানোর প্রচেষ্টা। সবটা মিলিয়ে রুপোলি পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক কদর্য সামাজের ইঙ্গিত বয়ে আনল সুশান্তর পরিণতি। তদন্তকারী দল এই তত্ত্বগুলোর কোনওটিকেই মান্যতা দিতে পারবে কি না, সেটা আলাদা প্রশ্ন। শুধু নামী এক প্রযোজনা সংস্থার কর্ণধারকে ডাক দিয়েছে জেরার জন্য।

Advertisement

এই পুরো ঘটনাটির পরিপ্রেক্ষিতে এক বার যদি এই মুহূর্তে বলিউডের ফিল্ম জগতের নায়ক-নায়িকাদের দিকে তাকাই, এটা খুব পরিষ্কার হয়ে যাবে যে উঠতি এই প্রজন্মের অধিকাংশ তারকাই তারকা-সন্তান। বরুণ ধবন থেকে আলিয়া ভট্ট। রণবীর কপূর থেকে সোহা আলি খান। অর্জুন কপূর থেকে টাইগার শ্রফ। সোনম কপূর এক বার বলেছিলেন, তারকার পুত্র বা কন্যা হওয়ার জন্য বিশেষ সুবিধা না পাওয়ার কোনও কারণ নেই, যেহেতু এই প্রিভিলেজ বা বিশেষ সুবিধা তাঁদের মা-বাবারা উপার্জন করেন তাঁদের সারা জীবন দিয়ে। অর্থাৎ, তিনি এক ভাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে তারকাসন্ততিদের তারকা হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা বেশি, এবং বিশেষ সুবিধা পেতে তাঁরা অভ্যস্ত।

এই প্রবণতা কি শুধু অভিনয় জগতে? মা-বাবার কর্মক্ষেত্র অনেক সময়েই সন্তানের জীবিকা নির্ধারণকে প্রভাবিত করে। উকিলের ছেলে উকিল। ডাক্তারের মেয়ে ডাক্তার। কলমিস্ত্রির ছেলে কলমিস্ত্রি। কৃষকের ছেলে কৃষক। এর মধ্যে আশ্চর্য কোথায়? সমাজের সব স্তরেই এই প্রবণতা আমাদের মতো দেশে দেখা যায়। কেন ? মা-বাবার ও সন্তানের জীবিকা এক হলে সুবিধা কী, অসুবিধাই বা কী— ব্যক্তিগত ভাবে সন্তানের, কিংবা সমষ্টিগত ভাবে সমাজের?

Advertisement

প্রথম প্রশ্ন, অর্থাৎ কেন বহু ক্ষেত্রেই মা-বাবার পেশাতেই যান সন্তান, তার উত্তর পাওয়া যেতে পারে অর্থনীতির একটি তত্ত্বে: প্রজন্মান্তরে শিক্ষা ও জীবিকার চলনের তত্ত্ব, পরিভাষায় যাকে বলে ইন্টার-জেনারেশনাল মোবিলিটি। সারা পৃথিবীর তথ্যের উপর গবেষণা বলছে, অধিকাংশ দেশে সাধারণত শিক্ষিত মা-বাবার সন্তানরাই শিক্ষিত হয়। অশিক্ষিত মা-বাবার ছেলেমেয়েরা সেই অশিক্ষার অন্ধকারে পড়ে থাকে বংশানুক্রমে বা তাদের মধ্যে মোবিলিটি বা চলন আসে খুব ধীরে। এই চলন বেশি হলে বোঝা যায়, উন্নয়নের প্রসার শুধু শিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি, অশিক্ষিত ও তুলনামূলক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলির মধ্যেও পৌঁছে গিয়েছে। এর জন্যে সরকারি নীতিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

নিউজ়িল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কানাডা ও ফিনল্যান্ডে এই ‘চলন’ খুবই বেশি। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে যে দেশগুলিতে এটা কম, ভারত পড়ে তাদের মধ্যেই। অর্থনীতিবিদ স্যাম আশের ২০১৮ সালে দেখিয়েছিলেন যে, বিশ্বায়নের পর থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে এই চলন ভারতে প্রায় স্থির অবস্থায় আছে, অর্থাৎ কোনও উন্নতি হয়নি। মানে, সর্বশিক্ষা অভিযানের মতো নীতিগুলি সমস্ত ভারতবাসীকে সমান শিক্ষার বাতাবরণ দিতে পারেনি। বরং তৈরি করেছে শিক্ষার এক দ্বৈত রূপ। শিক্ষিত ও তুলনামূলক ভাবে বিত্তবান মা-বাবারা ছেলেমেয়েদের বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়িয়ে আরও সুযোগ এনে দিয়েছেন তাদের সামনে। বাকিরা আঞ্চলিক ভাষার ইস্কুলে টালি-ওড়া ঘরে, ভাঙা ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে বসে নামতা মুখস্থ করেছে আর মিড-ডে মিলের লোভে হাজিরা দিয়েছে।

ঠিক এই ভাবেই প্রজন্মান্তরে জীবিকার চলন হিসেবে দেখলে বোঝা যায় যে আমাদের দেশে মা-বাবার কর্মক্ষেত্র অনেক সময়ই ছেলেমেয়েদের জীবিকা নির্ধারণে সাহায্য করে। এর জন্যে সহজাত ক্ষমতা বা ওই কাজ করার ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষা নিশ্চয়ই বেশি হতে পারে, কিন্তু সঙ্গে যুক্ত হয় মা-বাবার সামাজিক মূলধন বা সোশ্যাল ক্যাপিটাল। যাঁরা কোনও একটি বিশেষ বিষয়ে কাজে অনেক দিন ধরে যুক্ত থাকেন, তাঁদের নিজেদের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠতা বা বন্ধন গড়ে ওঠে, যা তাঁদের এক মূল্যবান সম্পত্তির মতো হয়ে দাঁড়ায়। এই মূলধন সহজেই তাঁরা সন্তানের, বা অন্য কোনও ঘনিষ্ঠ জনের জন্য ব্যবহার করেন। শিক্ষানবিশ হিসেবে ছেলেমেয়েরাও অনেক বেশি এবং সহজে সুযোগ পায়। তাই যে সব জীবিকায় শিক্ষানবিশ অবস্থায় সব কিছু শিখে নেওয়া খুব দরকারি, বা যে পেশায় সাফল্যের কোনও অবজেক্টিভ বা ব্যক্তিনিরপেক্ষ মাপকাঠি নেই, সেখানেই এই ধরনের চলন বা জীবিকার পরিবর্তন কম হয়। ফলত মানবদক্ষতা ও প্রতিভার ভুল এবং অপরিণত ব্যবহার হতে থাকে। সঙ্গে থাকে প্রেরণা হারানোর এবং হতাশার সম্ভাবনা।

এই ব্যাপারটা আরও একটি ক্ষেত্রে খুব দেখা যায়। ব্যবসায়ী পরিবারের বহু ছেলে উচ্চশিক্ষা পেয়ে এলেও শেষ পর্যন্ত ব্যবসার কাজেই যুক্ত হন। তাঁরা হয়তো নিজেদের আলাদা ব্যবসা শুরু করেন। এর পিছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। এক, ব্যবসায়ী পরিবারে মূলধনের জোগানের অসুবিধা কম থাকে। দুই, ব্যবসায়ী বাবা বা মা তাঁদের ব্যবসাসংক্রান্ত নানান অভিজ্ঞতা পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেন, যার থেকে তাঁরা নতুন স্টার্ট-আপেও অপেক্ষাকৃত সহজে সফল হতে পারেন। এই দেশে অবশ্য জীবিকা অনেক ক্ষেত্রেই জাতিগত পরিচিতির ওপর নির্ভর করে। কিছু শ্রমঘন জীবিকায় পূর্বপুরুষের রীতি মেনে কাজ করা এখনও দেখা যায়। বিশেষত চর্মকার, সাফাইকর্মী, শবদাহ সহায়ক ইত্যাদি জীবিকার সঙ্গে এই জাতীয় যোগাযোগ খুবই গভীর।

অর্থাৎ স্পষ্টতই, বলিউডে তারকাদের ছেলেমেয়েদের রমরমা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমাজের প্রায় সর্বত্র এর পরিচয় পাওয়া যায়। বলি-টলির বাজারে তাঁদের প্রাধান্য পাওয়ার আরও বড় কারণ ফিল্মের বাজারের চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা আর তথ্যের অভাব। সঙ্গে রয়েছে রেগুলেশন বা নিয়মের অনুপস্থিতি। ক’জনই বা জানে এই ফিল্মের বাজারে কত বিনিয়োগ হয়েছে, তার উৎস কী। অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে টেকনিশিয়ান, মেক-আপ শিল্পী, কে কত টাকা পান, কী ভাবে পান। তাঁদের সাফল্য বা ব্যর্থতার খতিয়ান শুধু টাকার অঙ্কে করা সম্ভব নয়। তবু কার ছবি কতটা বাণিজ্য করল, আর তাতে তাঁদের অবদান কত, এ নিয়ে তথ্য সবার সামনে আনা খুবই জরুরি। যে কোনও শিল্পক্ষেত্রেই নিয়মবিধি চালু করার দায়িত্ব সরকারের। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার প্রায় কিছুই হয়নি।

রইল বাকি তারকা-খচিত সমাজের নিজেদের মধ্যেকার যোগসাজশ এবং সামাজিক মূলধনের ধ্বংসাত্মক অপব্যবহারের প্রসঙ্গ। এই অবস্থায় একচেটিয়া শোষণ কমাতে উঠতি নায়ক-নায়িকারাও একটি ছাতার নীচে সংগঠিত হয়ে কাজ করতে পারেন। তাঁরা একে অপরকে সাহায্য করতে পারেন, হাত ধরতে পারেন কঠিন সময়ে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারেন। তা হলে বলি-টলির একচেটিয়া বাজার দ্বিপাক্ষিক একচেটিয়া বা বাইল্যাটেরাল মনোপলিতে পরিবর্তিত হবে। উঠতি শিল্পীদের মধ্যে এই ধরনের ভয়ঙ্কর পরিণতি কমবে।

সুশান্ত চলে যাওয়ার পরে শুনতে পাওয়া কিছু নায়ক-গায়ক-লেখক-সুরকারের সম্মিলিত আর্ত কণ্ঠস্বরকে বজ্রনির্ঘোষে পরিবর্তন করতে ভরসা রাখতে হবে তাঁদের সামাজিক মূলধনের ওপর। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে সুশান্তের এই অসময়ের মৃত্যু সেই সমস্ত শিল্পীদের সুযোগ করে দিল এই পরিস্থিতি নিয়ে সামনাসামনি আলোচনা চালানোর।

অর্থনীতি বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement