লড়াই: লকডাউনের সময় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়তে পারেন কোনও কোনও পড়ুয়া। ভেঙে না পড়ে করাতে হবে কাউন্সেলিং। ছবিটি প্রতীকী। ছবি: দেবরাজ ঘোষ
সপ্তাহ দেড়েক আগের ঘটনা। মুম্বই ফেরত এক তরুণী অবসাদে ভুগছেন। বাড়ি রেলশহর খড়্গপুরে। ততদিনে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে মুম্বইয়ে। আক্রান্তের সংখ্যা রোজই বাড়ছে। সেখান থাকার ঝুঁকি নেননি। বাড়িতে ফিরেও স্থির থাকতে পারছিলেন না পেশায় সফটঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ওই তরুণী। আতঙ্ক আর উদ্বেগে ভুগছিলেন। পরিস্থিতি এমনই হয়েছিল যে, রাতে ঘুমোতে পারেননি তিনি। সেই সময়েই তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রকের ওয়েবসাইট দেখেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রক একটি হেল্পলাইন নম্বর চালু করেছে। দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে মানসিক সমস্যায় ভুগলে ওই টোল ফ্রি নম্বরটিতে ফোন করা যাবে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্স এটি পরিচালনার দায়িত্বে।
হেল্পলাইনেরই সাহায্য নিয়েছিলেন খড়্গপুরের মেয়েটি। পশ্চিম মেদিনীপুরের বাসিন্দা জেনে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ প্রধানের নম্বর দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ পশ্চিম মেদিনীপুরের উপমুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ছিলেন। সম্প্রতি তাঁর পদোন্নতি হয়েছে। বর্তমানে তিনি উত্তর দিনাজপুরের জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। তরুণী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জানান, তাঁর কাছে একটা রাত যেন সাতটা রাতের সমান। তিনি যেহেতু মুম্বই থেকে ফিরেছেন, সেহেতু ‘এরপর কী হবে’ ভেবেই আতঙ্কিত। রবীন্দ্রনাথ ফোনেই তাঁর কাউন্সেলিং করেন। তরুণীকে জানান, অহেতুক আতঙ্কের কিছু নেই। আপাতত ‘হোম কোয়রান্টিনে’ থাকতে হবে। এ-ও জানান, করোনার উপসর্গই তাঁর নেই।
তরুণীর স্বীকারোক্তি, ‘‘ওই ডাক্তারবাবু (রবীন্দ্রনাথ) আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। বাড়ি ফিরে অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। ওঁর সঙ্গে কথা বলার পরে মনের অবস্থাটা বদলে যায়। ওঁর পরামর্শে আমি সবকিছু বুঝতে পেরেছি।’’ রবীন্দ্রনাথ বলছিলেন, ‘‘আগেও এ ভাবে অনেকের কাউন্সেলিং করেছি। মানসিক অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিকে দিশা দেখিয়েছি। ওই তরুণী অযথা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। আসলে কারও কারও মধ্যে এ ভাবে অজানা ভয়ভীতি চলে আসে। কাউন্সেলিং করিয়ে সেই ভয়ভীতি দূর করা জরুরি।’’
করোনা ঠেকাতে একুশ দিনের লকডাউন জারি হয়েছে। লকডাউনে বাইরে বেরোনোর উপায় নেই। বাড়ির বাইরে বেরোতে না পারায় অবসাদ গ্রাস করতে পারে। সব বয়সিরাই এর শিকার হতে পারেন। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে উদ্যোগী হয়েছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ও। প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছাত্রী, অধ্যাপক, আধিকারিক এবং কর্মীদের জন্য খোলা হয়েছে অনলাইন কাউন্সেলিং সেল। চলতি সপ্তাহ থেকেই এই সেল চালু হয়েছে।
কাউন্সেলিং কী ভাবে হতে পারে তার রূপরেখাও তৈরি হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে খবর। এই সেল চালুর বিজ্ঞপ্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এই সময়ে মানসিক ভাবে সুস্থ থাকা খুব জরুরি। লকডাউন চলছে। বাড়ির বাইরে বেরোনোর উপায় নেই। ঘরবন্দি থেকে কেউ কেউ অবসাদগ্রস্ত হতে পারেন। আসলে এর আগে কখনও এই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তাই সকলের কাছেই এটা সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। অবসাদ বা সমস্যা থেকে অব্যাহতি দিতেই এই সেল চালু হয়েছে। কাউন্সেলিং অনলাইনেই হবে। কেউ অবসাদে ভুগলে তাঁর কাউন্সেলিং খুব জরুরি।’’ বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে খবর, এই সেল চালু করার আগের একাধিক মনোবিদের সঙ্গে কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কাউন্সেলিং সেলে রয়েছেন কনসালট্যান্ট সাইকিয়াট্রিস্ট সিদ্ধার্থশঙ্কর দাস। রয়েছেন দু’জন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, শ্রাবণী শীল এবং আত্রেয়ী চন্দ্র। কনসালট্যান্ট সাইকিয়াট্রিস্ট সিদ্ধার্থশঙ্কর বলছিলেন, ‘‘এখন অবসাদ অন্যতম বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। শারীরিক অসুখের মতো এটাও একটা বড় অসুখ।’’ সিদ্ধার্থশঙ্কর জানাচ্ছেন, করোনা নিয়ে কারও কারও মধ্যে উদ্বেগ-আতঙ্ক রয়েছে। তা দূর করা জরুরি। এটা একটা দিক। আবার এই সময়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব হচ্ছে না। সেই কারণেও কারও মধ্যে উদ্বেগ, চাপ, অবসাদ আসতে পারে। অবসাদের মতো মানসিক সমস্যা দেখা দিলে কাউন্সেলিং করানো জরুরি।’’ মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, মানসিক ও শারীরিক রোগকে এখন এক সারিতেই রাখা হয়। এক সময়ে মানসিক রোগীদের নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক ছুঁৎমার্গ ছিল। এখন তা অনেক কমেছে। লকডাউনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ যদি মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হন, ইতস্তত না করে এই সেলে যোগাযোগ করতে পারেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে খবর, কাউন্সেলিংয়ে ইচ্ছুকেরা ইমেলে ওই সেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপেও যোগাযোগ করতে পারেন। কনসালট্যান্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের ইমেল, হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর ওয়েবসাইটের বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া হয়েছে। কার সঙ্গে কখন যোগাযোগ করা যেতে পারে, তা-ও উল্লেখ রয়েছে। শুরুতে যোগাযোগ করতে হবে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের সঙ্গে। কার কাউন্সেলিং প্রয়োজন, কথাবার্তার মাধ্যমে তা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করবেন তিনি। প্রয়োজনে তিনি কাউন্সেলিংয়ের জন্য যোগাযোগ করিয়ে দেবেন কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে। হোয়াটসঅ্যাপ অডিয়ো, ভিডিয়ো, এমনকী একটি অ্যাপের মাধ্যমেও কাউন্সেলিং হবে। সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
গত ৫ এপ্রিল ইউজিসি পড়ুয়াদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে এক নির্দেশিকা জারি করেছে। নির্দেশিকায় লকডাউনের সময়ে মানসিক অবস্থা দূর করতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে হেল্পলাইন বা অনলাইন কাউন্সেলিং সেল খোলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশিকা মেনে গড়বেতা কলেজ কর্তৃপক্ষ ৭ এপ্রিল ছাত্র ছাত্রীদের জন্য হেল্পলাইন ও অনলাইন কাউন্সেলিং সেল চালু করেছেন। এই সেলে দু’জন মনোবিদ-সহ রাখা হয়েছে বিভিন্ন বিভাগের আটজন অধ্যাপককে। খোলা হয়েছে হেল্পলাইনও। সেল ও হেল্পলাইনে মনোবিদ ও অধ্যাপকদের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর, ইমেল আইডি দেওয়া হয়েছে। কলেজের ওয়েবসাইটে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কলেজের অধ্যক্ষ হরিপ্রসাদ সরকার বলেন, ‘‘ইউজিসি-র নির্দেশ মেনে আমরা দ্রুত এই ব্যবস্থা করেছি। অনলাইন কাউন্সেলিং সেলে ফোন বা ইমেল পাঠিয়ে ছাত্র ছাত্রী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, অশিক্ষক কর্মী সকলেই পরামর্শ নিতে পারেন। সপ্তাহের সাতদিনই এই সেল ও হেল্পলাইন খোলা থাকবে।’’ ইংরেজি বিভাগের সঞ্চিতা দে, প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অদিতি সিংহ, সপ্তর্ষি পাল এই সেল খোলার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। শ্যামল সাহা, সুদীপ চৌধুরীর মতো কলেজের শিক্ষাকর্মীরাও এই ব্যবস্থা চালু হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
রোজ যাঁরা কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাঁদের পক্ষে একটানা বাড়িতে থাকা একপ্রকার অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। দিনের পর দিন ঘরবন্দি থাকার ফলে তাঁদের কেউ কেউ মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন। লড়াই এখন মূলত ভাইরাস ঠেকানোর। সে তো বাইরের লড়াই। অন্দরের আর অন্তরের লড়াইও কম নয়।
সব লড়াই লড়তে হবে একসঙ্গে। বলছেন মনোবিদেরা।
তথ্য সহায়তা: রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)