সম্প্রতি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা ‘টলমল’। শব্দটি যথাযথ। অর্থনীতি পুরোপুরি বেহাল না হলেও নিঃসন্দেহে ‘টলমল’। তবে একে মন্দা বলে দাগিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। বরং তাতে সমস্যা বাড়তে পারে— সবাই মন্দা এসেছে ভাবলে সত্যি সত্যিই মন্দা আসার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। গুজবের প্রভাবে এবং অন্যান্য কারণে মানুষের দল কী ভাবে ভেড়ার পালের মতো আচরণ করতে পারে, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম দিকের গবেষণায় সেই বিষয়ে একটি চমৎকার প্রবন্ধ ছিল। চতুর্দিকে এই ‘মন্দা, মন্দা’ শোরগোল শুনে সেই প্রবন্ধের কথা মনে পড়ছে। শোরগোল না তুলে বরং দেখা দরকার, কেন অর্থনীতির এই হাল, এর দাওয়াই-ই বা কী। নিশ্চিত উত্তর কারও জানা নেই। তবে হয়তো আন্দাজ করা যায়।
প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, জাতীয় আয়ের প্রধান দুটো ভাগ: ভোগব্যয় আর বিনিয়োগ। ভোগের অভ্যাস পাল্টানো শক্ত। কিন্তু বিনিয়োগ তেমন নয়, বিনিয়োগ দ্রুত ওঠানামা করে। এবং ঘটনা হল, মূলধনের উৎপাদনশীলতায় যদি বড় রকমের হেরফের না হয়, তা হলে আয়বৃদ্ধি নির্ভর করে বিনিয়োগের উপরে। বিনিয়োগ বাড়লে এক দিকে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, অন্য দিকে খরচ বাড়ার ফলে অন্যদের রোজগার বাড়ে, সেই সূত্রে বাড়ে ভোগব্যয়। ভারতে ভোগব্যয় কিছুটা কমেছে, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই বেশি কমেছে, কিন্তু বিনিয়োগের হার কমেছে অনেক বেশি, আর তাতেই মূল সমস্যা।
বিনিয়োগের অধোগতি আটকানো যায় কী ভাবে? সরকার ভাবছে সুদ কমালে বিনিয়োগ করার খরচ কমবে, তাই বিনিয়োগ বাড়বে। কিংবা, কর্পোরেট করের হার কমালে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ বাড়াবেন। দুঃখের কথা, পৃথিবীর কোনও দেশে সুদের হার কমালেই বিনিয়োগ বাড়ে না, কোনও কালেই না। কারণ আজকের বিনিয়োগ নির্ভর করে কালকের বাজারের চাহিদা ও মুনাফার প্রত্যাশার উপর। ঋণের ওপর কম সুদ দিতে হলে এখন ব্যবসার মুনাফা বাড়ে, কিন্তু সেটা বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে না। বরং এ দেশে এক বিশালসংখ্যক নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ সঞ্চিত অর্থ ব্যাঙ্কে রাখেন। সুদ ক্রমশ কমাতে কমাতে সরকার এই শ্রেণির খরচ করার ক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছে। তাতে চাহিদার ঘাটতি আরও বাড়ছে। আর কোম্পানি করের হার বেশি বলে ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা নেই, তাই তাঁরা বিনিয়োগ করতে পারছেন না— ভারতে সেটা ঠিক নয়। অন্য কারণে বিনিয়োগে ঘাটতি হচ্ছে কি না সেটা দেখা প্রয়োজন।
এখানেই নোট বাতিল তথা কালো টাকা উদ্ধারের প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক। নোট বাতিল করে সরকার সেই সময়ের কালো টাকার ‘স্টক’ বা মজুত ভাণ্ডারে কিছুটা থাবা বসিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার ‘ফ্লো’ অর্থাৎ স্রোত সম্ভবত কমাতে পারেনি। কালো টাকা যে নেই তা নয়, হয়তো অনেকেই সে টাকা এমন কিছুতে বিনিয়োগ করছে না, সরকার যা সহজেই ‘দেখতে’ পাবে। বাড়ি বা দামি গাড়ির মতো বিনিয়োগধর্মী অধিকাংশ ব্যয়ের ক্ষেত্রেই এটা একটা সমস্যা। লক্ষণীয়, ভারতে বাড়ির কেনাবেচা বা তৈরির কাজকর্মে হতোদ্যম অবস্থা। কেন? এই ব্যবসায় যুক্ত যাঁকেই জিজ্ঞেস করুন, তিনি বলবেন, বাড়ির ব্যবসায় যে নগদ টাকা ব্যবহার হত, তার জোগানে ভাটা পড়েছে। এ দেশটার অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিশেষ ভাবে কালো টাকার ওপর নির্ভরশীল, এই তিক্ত সত্যটি নেতানেত্রী থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরাও মানতে চান না। অসংগঠিত ক্ষেত্রে, বিশেষত বাড়ির ব্যবসায় নিয়োজিত মূলধনে এর অবদান অনেক। এই প্রসঙ্গে বলি, আর কিছু দিন বাদেই আইএমএফ-এর সদর দফতরে এ বছরের অ্যানুয়াল স্ট্যাটিস্টিক্যাল ফোরাম অনুষ্ঠিত হবে, এ বারের আলোচ্য বিষয় হল অসংগঠিত অর্থনীতির আয়তন মাপবার পদ্ধতি। সেখানে যে সব গবেষণাপত্র পঠিত হবে, তাতে অনেকেই বলছেন, কী ভাবে কালো টাকা বিভিন্ন দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। এ দেশও ব্যতিক্রম নয়।
দেশের অর্থনীতি টলমল হলে সরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে এবং কিছু ক্ষেত্রে সরকারি ভোগব্যয় বাড়িয়ে অবস্থা সামাল দেওয়া চেষ্টা একটা বহুপরিচিত নীতি। কিন্তু প্রশ্ন হল, সরকারের আয় না থাকলে ব্যয় করবে কোথা থেকে? রাজস্ব আদায়ে ভাটার টান চলছে, বিশেষত জিএসটি বাবদ আয় পরিকল্পনা মাফিক হচ্ছে না বলেই শোনা যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে বলি, ভারতের বিভিন্ন শহরে ব্যবসায়ীরা অনেকেই খোলাখুলি ভাবে জিএসটি দিচ্ছেন না— কর দিলে এক রকম রসিদ আর না দিলে এক রকম, এই ব্যবস্থা তো আমাদের দেশে বহুলপ্রচলিত! তার ওপর দুর্বল ব্যাঙ্কগুলিকে নতুন মূলধন দিতে হচ্ছে। তার সঙ্গে আছে ভোটের রাজনীতির কারণে লাগামছাড়া বদান্যতার দায়।
তা হলে কী করণীয়? ভোগব্যয় এবং বিনিয়োগ, উভয় ক্ষেত্রেই অনিশ্চয়তা এবং আশঙ্কা কমাতে হবে। সুদের হার স্থিতিশীল রাখার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। যে করেই হোক সরকারকে যথার্থ উৎপাদনশীল বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং ছোট ও মাঝারি ব্যবসার পরিচালকদের বরাত দিতে হবে। বড় ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণ-নেওয়া টাকা ঠিকঠাক জায়গায় বিনিয়োগ না করলে কর ছাড়ের সুবিধা প্রত্যাহার করতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সফল হওয়ার মতো দক্ষতা অর্জন না করলে ভারতীয় শিল্প দাঁড়াতে পারবে না।
সরকার যে কিছুই করছে না, তা নয়। কিন্তু বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রবণতা আর তুচ্ছ জিনিস নিয়ে লাফালাফি একটু বেশি। আর, দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে গেলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ শুনতে হবে, রাম-শ্যাম-যদু-মধু অর্থনীতি নিয়ে কী ভাবেন সেই অনুসারে নীতি রচনা ও রূপায়ণ করতে চাইলে ফল খারাপ হতে বাধ্য।