ভেঙে পড়েছে গাছ। কাটোয়ার খালপাড়ায়। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়
করোনার পরে ঘূর্ণিঝড় আমপানের তাণ্ডবে কার্যত লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে দক্ষিণবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলা। দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনা, কলকাতা-সহ গাঙ্গেয়বঙ্গের উপর দিয়ে এই ঝড় চলে যাওয়ার পরে এই এলাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন দ্বীপে রূপান্তরিত হয়েছিল। গাছ উপড়ে, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে, বিদ্যুৎ, জল সরবরাহ, ইন্টারনেটের মতো পরিষেবাগুলি দীর্ঘ সময়ের জন্য ব্যাহত হয়েছিল। দুই ২৪ পরগনার সুন্দরবন এলাকায় ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। জীবনহানি আগের ঝড়গুলির তুলনায় কম হলেও, বাড়িঘর, কৃষি-সহ অর্থনৈতিক জীবন বিধস্ত হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে যে পরিকাঠামোগুলি তৈরি করা হয়েছিল তা কার্যত এক লপ্তে নষ্ট করে দিয়েছে আমপান। তারই সঙ্গে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, আমাদের বিপর্যয় মোকাবিলা ব্যবস্থা এমন ঝড় সামলাতে পর্যাপ্ত কি না তা নিয়েও।
এই ঝড়, বৃষ্টির কারণে পূর্ব বর্ধমানের বিস্তীর্ণ এলাকার চাষের ক্ষতি হয়েছে। বহু কৃষক অনিশ্চয়তার শিকার। ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে তাঁরা যাতে ঠিকমতো ক্ষতিপূরণ পান সে দিকে প্রশাসনকে নজর দিতে আবেদন জানাচ্ছেন অনেকে। ঝড়ের প্রভাব কৃষিক্ষেত্রে পড়লেও কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলির তুলনায় দুই বর্ধমানে গাছ উপড়ে যাওয়ার সংখ্যাটি তুলনামূলক ভাবে কম। বিদ্যুৎ সরবরাহের এই সঙ্কটের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে গাছ উপড়ে পড়াকে। দেখা যাচ্ছে শহরের রাস্তায়, হাইওয়ের ধারে যে গাছ লাগানো হয়েছিল তার একটি বড় অংশ আমপানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি হিসেব বলছে, শুধু কলকাতা শহরেই নাকি ১৫ হাজার গাছের ক্ষতি হয়েছে। এই বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে গাছ লাগানোর উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাবকে দায়ী করছেন পরিবেশপ্রেমীদের একাংশ। কী ধরনের গাছ, শহরের কোথায় লাগানো উচিত তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরিকল্পনা না করেই গাছগুলি লাগানো হয়েছিল বলে অভিযোগ। একাংশের মতে, এই ধরনের গাছগুলির শিকড় না কি, মাটির গভীরে যায় না। ফলে, আমপানের মতো ঝড় সামলানো এই ধরনের গাছগুলির পক্ষে সম্ভব হয়নি। যদিও এর বিরুদ্ধ মতও রয়েছে। যেমন, বিপর্যয় মোকাবিলা দলের কয়েক জন সদস্য জানিয়েছেন, যে সব গাছের শিকড় মাটির গভীরে ছিল সেগুলিও যে এই প্রচণ্ড ঝড় থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছে তা নয়। বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে উপড়ে না গেলেও মাঝখান দিয়ে কার্যত দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে এই ধরনের গাছগুলি। ফলে শিকড় গভীরে প্রোথিত থাকলেই যে এই বিপর্যয়ে গাছগুলিকে রক্ষা করা যেত এই যুক্তি সবাই মানতে রাজি নন।
গাছ লাগানোয় পরিকল্পনার অভাব নিয়ে যতই বিতর্ক চলুক না কেন, পরিবেশপ্রেমীরা জানাচ্ছেন, এই দুর্যোগের পরে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল যে, এ বছর থেকে গাছ লাগানোয় আমাদের বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে, পরে এই ধরনের দুর্যোগের মোকাবিলা করা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এই বিষয়ে বর্ধমান শহর ও পূর্ব বর্ধমান জেলার নানা প্রান্তের পরিবেশপ্রেমীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গাছ লাগানোর উপরে এ বছর থেকে বাড়তি গুরুত্ব না দিলে সবুজায়নে আমাদের অনেকটা পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তার জেরে বাড়তে পারে পরিবেশ দূষণও। পরিবেশপ্রেমীদের দাবি, নদীর ধারে গাছের যে ক্ষতি হয়েছে তা দ্রুত পূরণ করতে না পারলে আগামী দিনে ভাঙন, ভূমিক্ষয়ের মতো ঘটনা বাড়তে পারে। তাই নদীর তীরবর্তী এলাকার মাটি ক্ষয়রোধে বনসৃজনের আশু প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, আকারের দিক থেকে আমপান ঝড়টি আগের ঝড়গুলির তুলনায় অনেক বড়। এর শক্তিও আগের ঘূর্ণিঝড়গুলির থেকে বেশি। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে সব সময়েই একটা বাস্তব ও সম্ভাবনার দ্বন্দ্ব লেগে থাকে। অনেক সময়েই প্রকৃতির খেয়ালের সঙ্গে বিজ্ঞানীদের অনুমান মেলে না। ফলে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ঢোকার কথা থাকলেও ঘূর্ণিঝড়ের দিক পরিবর্তন করে অন্য দিকে সরে যাওয়ার ঘটনাও বেশ কয়েক বার ঘটেছে। সে দিক থেকেও আমপান সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী। শুরু থেকেই বিজ্ঞানীদের অনুমান করে দেওয়া পথ ধরে সে এগিয়েছে, নির্ধারিত সময়েই সে স্থলভাগে এসেছে, নির্ধারিত গতিবেগেই আঘাত হেনেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই সময়ে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের উপরে একটি উচ্চচাপ বলয় থাকায় আমপানের কোনও দিক পরিবর্তন ঘটেনি। বিজ্ঞানীদের আরও আশঙ্কা, উত্তর ভারত মহাসাগরে আগামী দিনে যে ঝড়গুলির সৃষ্টি হতে চলেছে তাদের শক্তি ও আকার—দুই হবে আমপানের সমতুল্য বা তার থেকেও মারাত্মক। ফলে আগামী দিনে এমনই ধ্বংসলীলার সাক্ষী থাকতে হবে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। একটি সমীক্ষা বলছে, আগামী দিনে আবহাওয়া পরিবর্তন ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দুই ২৪ পরগনা ও কলকাতার মতো উপকূলবর্তী শহরে ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
এর আগে আয়লা, ফণী বা বুলবুল দেখেছি আমরা। এর মধ্যে আয়লা ছাড়া বাকি ঝড়গুলি সরাসরি এই রাজ্যে আঘাত করেনি। আরও একটি সুবিধা আমাদের আছে। এই ধরনের ঝড়ের সামনে কার্যত প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে বড় ধরনের দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেছিল সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভেরা। কিন্তু গত কয়েক দশকে সেই প্রাকৃতিক দেওয়ালকে ঘিরেও নানা আশঙ্কা দানা বাঁধছে। সুন্দরবনের গাছ ও জীববৈচিত্র বিপন্ন হয়ে পড়া, সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা বৃদ্ধি, ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ক্ষয়ের কারণে আগামী দিনে আমাদের বড় ধরনের মাসুল দিতে হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন পরিবেশবিদেরা। তাঁদের দাবি, অবিলম্বে ‘প্রাকৃতিক দেওয়াল’ সুন্দরবনের অরণ্যের পুনর্গঠনের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হল, যে ভাবে অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে একের পর এক প্রলয়ঙ্কর ঝড় আছড়ে পড়ছে তাতে সেই প্রচেষ্টা ধাক্কা খাবে। তবে এই আশঙ্কার মধ্যেই কাজ করে যেতে হবে বলে দাবি করেছেন গবেষকেরা। আর এটা প্রমাণিত সত্য যে, প্রাকৃতিক প্রাচীর হিসেবে সুন্দরবনের মতো বৃহদায়তন অরণ্য না থাকলে গোটা পশ্চিমবঙ্গই আগামী দিনে ঝড়ের সামনে কার্যত দিশাহারা হয়ে পড়বে।
সামনের দিনগুলিতে আমাদের পথচলা মোটেই সুখকর নয়। এক দিকে, করোনা অতিমারির সংক্রমণ থেকে পৃথিবীকে সারিয়ে তোলা, অন্য দিকে প্রকৃতির নানা ক্ষত মেরামত— এই দুই কাজই মানব সমাজের কাছে এখন অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ। গবেষকেরা বারবার বলেছেন, এই ঝড়ে গাছের যে ক্ষতি হয়েছে তার পূরণ করতে না পারলে প্রতিকূলতা আরও বাড়বে। সন্দেহ নেই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি। আপাতত সাময়িক ভিত্তিতে এই ক্ষতির মাশুলও আমাদের গুনে যেতে হবে। কারণ, এত গাছের বিকল্প অল্প সময়ের মধ্যে তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। গবেষকেরা বলছেন, সাময়িক ক্ষতিকে মেনে নিয়েই গাছরক্ষা ও বনসৃজনে উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।