অঙ্কন: কুণাল বর্মন
বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বের পাশাপাশি বেশ কিছু প্রশাসনিক দায়িত্বও সামলেছেন। এ ক্ষেত্রে আরও কিছু সংযোজন হল। আসলে তাঁর কর্ম রূপায়ণ দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েই কর্তৃপক্ষ তাঁকে এই দায়িত্বগুলি দিতেন। ১৮৫৪ সালে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ বন্ধ করে সেখানে বোর্ড অব এগজামিনার্স স্থাপন করা হয়। তাঁকে সেখানকার এক জন সক্রিয় সদস্য হিসেবে রাখা হয়। এ ছাড়া ফ্রেডারিক হ্যালিডের নির্দেশে ঠিক করা হল যে, বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এ ছাড়া বিদ্যালয় পরিদর্শকই সবরকম কর্তৃত্ব করবেন। হ্যালিডের ইচ্ছেতেই বিদ্যাসাগর সহকারী পরিদর্শকের পদ পেলেন। ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুলেরও তিনি পরিচালন সমিতির সদস্য ছিলেন। তার পরে সম্পাদক হলেন। এটাই পরবর্তীতে হিন্দু মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন হয়। এখন এখানেই বিদ্যাসাগর কলেজ।
বিদ্যাসাগর অনুভব করেছিলেন সমাজে নারীরাই সব দিক থেকে বঞ্চিত। তাঁদের শিক্ষা হলেই সমাজও শিক্ষিত হবে। শুধু তাই নয়, প্রকৃত শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত নারীরাই বুঝতে পারবেন কোথায় তাঁদের অসম্মান। নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি সহায়তা পেলেন বেথুন সাহেবের। ১৮৪৯ সালের ৭ মে তৎকালীন গভর্নর জেনারেলের ব্যবস্থা-সচিব ও এডুকেশন কাউন্সিলের সভাপতি ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন বেথুন কলেজের প্রতিষ্ঠা করেন। এটার নাম তখন অবশ্য ছিল ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল। এখানকার অবৈতনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিদ্যাসাগরকে যা তিনি দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন। মূলত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়াটা তাঁর স্ত্রী-শিক্ষা প্রসার কর্মসূচির পক্ষে সহায়কই হল। তিনি নদিয়া, হুগলি, বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলার স্কুল ইন্সপেক্টর হিসেবে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে সচেষ্ট হলেন।
বিদ্যাসাগরকে প্রবল আক্রমণের মুখে পড়তে হল অনিবার্য ভাবেই। কবি ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর এই স্ত্রীশিক্ষাকে তীব্র ব্যঙ্গ করে ছড়া লিখলেন, ‘যত ছুঁড়ীগুলো তুড়ী মেরে কেতাব হাতে নিচ্চে যবে, / এ বি শিখে বিবি সেজে বিলাতি বোল কবেই কবে;/ আর কিছুদিন থাকরে ভাই! পাবেই পাবে দেখতে পাবে,/ আপন হাতে হাঁকিয়ে বগী গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে।’ এ ছাড়া স্কুলগুলি স্থাপনে যে বিপুল অর্থব্যয় হচ্ছিল তাতে সমর্থন ছিল না শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর ইয়াং গার্ডেনের। কিন্তু বিদ্যাসাগর তাঁর সঙ্কল্পের রূপায়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, তাঁর অদম্য মনোবলের জন্য।
ইতিপূর্বে রামমোহন রায়ের উদ্যোগে ১৯২৯ সালে সতীদাহ প্রথা রদ হয়েছিল। কিন্তু বিধবাদের উপর সমাজের অত্যাচার চরমে পৌঁছেছিল। বাল্যবিবাহের মতো একটি অযৌক্তিক বিষয়ও আমাদের সমাজে প্রচলিত ছিল। আবার বল্লাল সেনকৃত কৌলীন্য প্রথার বাস্তবায়নে সমাজে কুলীনদের বহুবিবাহও প্রচলিত ছিল। ফলে নারীর ব্যক্তিমর্যাদা হয়েছিল লুণ্ঠিত। বহুবিবাহকারী পুরুষটির কাছে স্ত্রীরা সংখ্যায় চিহ্নিত হতেন। নারীর এহেন অবহেলিত পরিস্থিতি অনুভব করেই বিদ্যাসাগর সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধিতে কলম ধরলেন।
মানুষের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে বাসা বেঁধে থাকা কুসংস্কারগুলি তিনি দূর করতে চাইলেন। মনে করা হত যে, নারীরা শিক্ষিত হলে স্বেচ্ছাচারিণী বা স্পষ্ট করে বলতে গেলে দুশ্চরিত্রা হবেন। এ ছাড়া স্বামীরও আয়ুক্ষয় হবে। রামমোহন যে আন্দোলনের শুরু করেছিলেন তাকেই আরও আলো দিলেন বিদ্যাসাগর। আসলে নারীজাতির দুর্গতিমোচনকে জীবনের অন্যতম ব্রত হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। একের পর এক প্রবন্ধ লিখে তিনি মানুষের চেতনা জাগাতে সচেষ্ট হলেন। বিধবা বিবাহের পক্ষে লিখলেন ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৫)। আবার যুক্তির পরে যুক্তি সাজিয়ে তিনি লিখলেন ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’(প্রথমটি ১৮৭১, দ্বিতীয়টি ১৮৭৩)। এ ছাড়া ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামেও প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। মূলত বাল্যবিবাহের সমস্যা আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি হিন্দু বিধবার নিদারুণ দুর্ভোগের কথা বলেন। এই সমস্যার সমাধান হিসেবে তাঁদের পুনর্বিবাহদানের কথাই তিনি বলেছেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় অবশেষে সিলেক্ট কমিটি গ্রান্ট সাহেবের প্রস্তাবিত আইনের খসড়া অনুমোদন করেন এবং ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই বিধবা-বিবাহ-আইন বিধিবদ্ধ হয়।
তবে বিষয়টির বাস্তবায়ন ঘটানো মুখের কথা ছিল না। তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজ তাঁকে নিয়ে উঠে-পড়ে লাগে। কিন্তু তিনি যে অনন্য চারিত্রিক ঋজুতা জন্মসূত্রে পেয়েছেন। তাই নিজ সঙ্কল্পে স্থির থেকে বিরুদ্ধ শক্তির কাছে অনমনীয়তা বজায় রেখে নিজ ব্রতে সফল হয়েছেন। এমনকি ১৮৭০ সালে নিজের ছেলে নারায়ণচন্দ্রর সঙ্গে বিধবার বিয়ে দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, কথা ও কাজে তিনি এক। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তাঁর ভূমিকা যেমন সাহসিকতার তেমনই
মহত্ত্বের দৃষ্টান্ত।
বিধবা বিবাহ যে শাস্ত্র অনুমোদিত আর বহু বিবাহ যে শাস্ত্রসম্মত নয়, এ বিষয়ে হিন্দুশাস্ত্র থেকে দৃষ্টান্ত উদ্ধার করে দেখিয়েছিলেন তিনি। কারণ, সমসময়ে প্রভূত বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। ভাবতে অবাক লাগে ১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন পাশ হয়ে গেলেও বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর কাহিনিতে বিধবার বিয়ে দিলেও তাঁদের অকালে অপঘাতে মৃত্যু বিধান দিয়েছিলেন। বঙ্কিমের কুন্দনন্দিনী ও রোহিণীর পরিণাম প্রমাণ করে যে, বঙ্কিম বিধবাবিবাহ সমর্থক ছিলেন না। শুধু আইন পাশ নয়, বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ বাস্তবিক প্রচলনের জন্য প্রত্যক্ষ ভাবে কাজে লাগলেন। ফলে বিবাহপ্রদান কাজে তাঁর প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি বিধবা বিবাহের নাম করে অনেকে তাঁকে ঠকিয়েও টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন বলেও জানা যায়।
নারী জাগরণের ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের নামটি সর্বাগ্রে উল্লেখ্য। বর্তমানে নারীর ক্ষমতায়ন সুপ্রতিষ্ঠিত। সর্বস্তরের নারী শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন। নারীর নিরাপত্তা তথা সুরক্ষা নিয়ে অনেক অমীমাংসিত সমস্যা আজও আছে। কিন্তু বিদ্যাসাগর যা করে গিয়েছেন তার কোনও তুলনা হয় না। তাই এক জন প্রকৃত নারীহিতৈষী মানুষ, বিদ্যাসাগরকে কুর্নিশ।
শিক্ষিকা, শ্রীপৎ সিং কলেজ