শুধু উদ্যাপনের জন্য নয় জীবন, যাপনের জন্যও। জীবনে মেলার বিকল্প মেলাই। কোনও মেলা ধর্মজাত, কোনওটি লোকায়ত। আর এই উৎসবগুলি আমাদের শিকড়। যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মাটির ছোঁয়া। শিলিগুড়ি লাগোয়া ভারত-বাংলাদেশে সীমান্ত ব্লক ফাঁসিদেওয়ার মুন্সিবাড়ির উরসের মেলা তেমনই সম্প্রীতির এক মহামিলন ক্ষেত্র। প্রতি বছর ফাঁসিদেওয়ার জালাস নিজামতারা গ্রাম পঞ্চায়েতর অন্তর্গত এক অখ্যাত গ্রাম মুন্সিবাড়িতে অগ্রহায়ণের শেষ দিন থেকে পয়লা পৌষ (এ বার ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর) এই উরস উৎসবের আয়োজন করা হয়।
নদনদী আর শ্যামলিমায় ঘেরা ফাঁসিদেওয়ার মুন্সিবাড়ির পশ্চিমে বয়ে চলেছে বুড়ি বালাসন। গ্রামটির প্রকৃত নাম ভেল্কু জোত হলেও মুন্সিবাড়ি নামেই পরিচিত। বিভিন্ন আদিবাসী জনজাতি ও সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় এবং নেপালিদের বাস এই গ্রামে। লেউসিপাড়ি, ভুসিভিটা, টামবাড়ি, টাওয়া জোত কেবোল জোত-সহ একাধিক গ্রামীণ বসতি রয়েছে এই গ্রামে। অগণিত জনতার আনাগোনায় অগ্রহায়ণের সংক্রান্তি আর পয়লা পৌষ জমজমাট হয়ে ওঠে মুন্সিবাড়ি। সম্প্রীতির এই তীর্থক্ষেত্রে মিলিত হন প্রচুর মানুষ।
হজরত পির আবিরুদ্দিন মহম্মদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ফি বছর মুন্সিবাড়ির উরস উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। পির আনুমানিক ১৯৪৭ সাল নাগাদ মুন্সিবাড়িতে আসেন। বিপুল পৈত্রিক সম্পত্তি ছেড়ে শুধুমাত্র ধর্মের কথা শোনাতেই মুন্সিবাড়িতে তাঁর আগমন। পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল ঘুরে বেড়াতেন তিনি। প্রায় তিন বছর থাকার পর ফিরে যান পির। মুন্সি বাড়িতে তিন বছর পর ফিরে আসেন জহরত আবিরুদ্দিন পির। শুরু করেন ধর্মপ্রচার। পিছিয়ে থাকা এই এলাকায় তখন সামসুল হুদা মাদ্রাসা খুলে শিক্ষা দান করছিলেন। পির বিনামূল্যে শিক্ষাদানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁকে স্মরণে-মননে রাখতেই এলাকার মানুষের উদ্যোগে শুরু হয় উরস উৎসব। এ বছর তা ৫৪তম বছরে পা দিল। হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ সম্প্রদায় নির্বিশেষে এই উৎসবে অংশ নেন। পিরের মাজারে মিলিত হন সব ধর্মের মানুষজন।
মাজারের সামনে ধূপ, মোমবাতি প্রজ্বলনের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ মানত করেন, চাদর চড়ান মাজারে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ মুন্সিবাড়ির উরসের মেলা। ধূপের গন্ধ আর আজানের সুরে দু’দিনের উরস উৎসবে উত্তরবঙ্গের ঐক্যের সংস্কৃতিই উদ্যাপিত হয়। মসজিদের পাশে মেলাও বসে। রাতভর মেলাপ্রাঙ্গণ প্রচুর মানুষের আনাগোনায় জমজমাট হয়ে ওঠে। শীতবস্ত্র থেকে শুরু করে কাঠের আসবাবপত্র, সংসারে ব্যবহারের দৈনন্দিন সামগ্রী, খেলনা এবং নানা রকমের খাবারের পসরা নিয়ে ব্যবসায়ীরা হাজির থাকেন মেলাপ্রাঙ্গণে। উরস মেলা সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করার দায়িত্ব গ্রামবাসীরা নিজেরাই নেন প্রতি বছর। প্রচুর ভিড়ের জন্য এলাকায় যান নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়। উৎসব এবং মেলায় ভিড় প্রতি বছরই বাড়ছে। শিলিগুড়ি এবং পার্শ্ববর্তী বহু এলাকার মানুষজন এই উৎসবে অংশ নেন। এই গ্রামের চারপাশে রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষজন এবং জনজাতির বাস। গ্রামের মাঝখানে রয়েছে এই পিরের মাজার আর মসজিদ। উরস উৎসব উপলক্ষে প্রতি দুপুরে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে খিচুড়ি খাওয়ানো হয়। সম্প্রীতির এই উৎসব ঘিরে ধর্মীয় আলোচনাসভা এবং জলসার আয়োজনও করা হয়।
এই উৎসবকে ঘিরে মানুষের উৎসাহ ও উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো। ভেদবুদ্ধি বা সঙ্কীর্ণতার বিপক্ষে এই উৎসব সরাসরি মিলনের বার্তা দেয়। গ্রামভারতের চিরন্তন ছবি ধরা পড়ে এই উৎসবে। ধরা পড়ে উত্তরবঙ্গের নমানুষের বেঁধে-বেঁধে থাকার যাপন। ভেদাভেদ এখানে স্থান পায় না। চার পাশের অন্ধকারের মধ্যে, দমবন্ধ করা পরিবেশের মধ্যে, নিরন্তর অশান্তির মধ্যে মুন্সিবাড়ির উরস উৎসব সম্প্রীতির চিরকালীন দিশা দেখায় প্রতি বছর।
(লেখক নজরুল শতবার্ষিকী বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)