নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
ছড়াটা বামপন্থী এবং পুরনো। ৬০-এর দশকে বেশ জনপ্রিয় ছিল। নতুন শতকের দ্বিতীয় দশকে পা দিয়ে, বাজেটের প্রাক্কালে ফের মনে পড়ল: যখনই জনতা চায় চাকরি ও খাদ্য/ সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য।
‘যুদ্ধ’ এই মুহূর্তে (আপাতত) নেই। যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব ছিল ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ঠিক আগে, বালাকোট কাণ্ডকে ঘিরে। তার আগে নরেন্দ্র মোদীর ২০১৪-র চমকপ্রদ ‘বিকাশ’-ওয়ালা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রাখার ব্যর্থতা আর অর্থনীতির বেহাল অবস্থা নিয়ে নিউজ-প্রিন্ট আর টেলিভিশনের প্রাইম টাইম কম খরচ হয়নি। সামাজিক বিন্যাস আর অর্থনীতির অনেক সংখ্যাতত্ত্বের কচকচি করে প্রায় অধিকাংশ ভোট-পণ্ডিত বলেছিলেন— এ বার মোদী হয় ফিরবেন না, নয় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অহমিকায় নয়, তাঁকে চলতে হবে নানা ভাবধারা ও সামাজিক ভিত্তির জোট শরিকদের ভরসায়। সে সব ভবিষ্যৎ-বাণী উগ্র জাতীয়তাবাদের ঢেউয়ে ভাসিয়ে, আরও বেশি শক্তি সঞ্চয় করে একক ভাবে মোদী ফের ক্ষমতায়।
লোকসভার পর সারা দেশে এখন অন্য রকম সংঘর্ষ চলেছে। অর্থনীতির এ বারও হাঁড়ির হাল। কিন্তু তার চেয়ে জনসংখ্যাগত (ডেমোগ্রাফিক) রাজনীতি ও তার প্রধান তিন বাহন— জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি), সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জি (এনপিআর) নিয়ে উত্তাল ভারতের নানা অংশের সাধারণ মানুষ ও ছাত্রছাত্রীরা।
এই ব্যবস্থাগুলিতে সবচেয়ে আতঙ্কিত ও আন্দোলিত মুসলিম সংখ্যালঘুরা (বিশেষতসংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে, যেখানে অন্য ছয় সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের নাগরিকত্বের কথা বললেও, মুসলিমদের বাদ দেওয়া হয়েছে) এবং পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশ থেকে আগত সম্প্রদায় নির্বিশেষের সবাই, কেন না, জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জিতে নাম তোলার সময়, নিজেদের জন্মের প্রমাণপত্র (মুখ্যত বার্থ সার্টিফিকেট) রেশন/ভোটার/আধার কার্ড কিংবা পাসপোর্ট নয়, বাবা-মায়ের জন্মস্থানের হদিশও সপ্রমাণ জানাতে হবে। যদি না জানাতে পারেন, তবে সেই কলামে পড়বে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। এবং, এই সব তথ্যই শেষাবধি জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরির সময় লাগবে, যার সাম্প্রতিকতম প্রয়োগ দেখেছে অসম। নাগরিকপঞ্জিতে বাদ পড়া ১৯ লাখ লোকের মধ্যে (যাঁদের জন্য তৈরি হয়েছে/হচ্ছে ডিটেনশন কেন্দ্র) ১২ লাখ হিন্দু!
ফলে, এই চূড়ান্ত মাগ্যিগণ্ডার কাঁচাবাজারে (শুধু পেঁয়াজের ঝাঁজ নয়, আক্রায় আলু সব্জিকেও আমিষবৎ ঠেকছে) কারও মুখে সাড়া নেই, কোনও বড় আন্দোলন নেই। আন্দোলন যা কিছু এনআরসি/সিএএ নিয়ে। আর্থরাজনীতির বাকি সব ‘মুদ্দা’ এখন শিকেয় তোলা। রেশন দোকানের চেয়ে জেরক্সের দোকানে লাইন এখন লম্বা। বিশেষত, পূর্ববঙ্গীয় অধ্যুষিত অঞ্চলে। কারণ, মোদী-২ সরকারের শাসনে আর্থসামজিক বিকাশ ও তার বিতরণ নয়, আত্মপরিচিতির রাজনীতিই সবার মন অধিকার করে আছে। অথচ, সাধারণ মানুষ বা মধ্যবিত্ত থেকে ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোগী সবাই বেশ কষ্টে আছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চড়া দামে কোমর ভাঙছে, বিশেষ করে, প্রত্যক্ষ কর না-দেওয়া আমজনতা; ক্রম-হ্রাসমান ব্যাঙ্কের সুদ অবসরপ্রাপ্ত মধ্যবিত্তের ঘুম ছুটিয়েছে; নোটবন্দি-র প্রলম্বিত ছায়া আর জিএসটি-র জটিলতায়, ব্যবসায়ী মহলে সবারই মুখে ‘ধান্দা এখন মন্দা’ চলেছে। ফলে, জিডিপি-র বৃদ্ধির হার যে এখন অতি নিম্নমুখী তা জানতে ‘অভিজিৎ বিনায়ক’ হতে হয় না, থলে হাতে মাঝে মাঝে বাজার গেলে আর চোখকান খোলা রেখে নানা শ্রেণির কথা শুনলেই বোঝা যায়।
যে সব মুষ্টিমেয় অর্থশাস্ত্রী একসময় মোদী-অর্থনীতির সমর্থক ছিলেন, তাঁরাও আজ উল্টো সুর গাইছেন। উর্জিত পটেল-এর পর, ‘অর্থনীতি বোঝেন’ এমন কাউকে এখনও অবধি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের যোগ্য পাওয়া গেল না। অথচ, ওই ব্যাঙ্কের সঞ্চিত ভাণ্ডার থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে। এটা কি রাজনীতির মতোই অঘোষিত আর্থিক জরুরি অবস্থার সমতুল নয়? আসলে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার দিশাহীন। তাঁরা জানেন না, শ্যাম না কুল কোনটা রাখবেন। ইরানের তেল না মার্কিনি দোস্তি। এরই মধ্যে, ‘দ্য ইকনমিস্ট’ বিজেপি শাসিত বর্তমান ভারতকে ‘অসহিষ্ণু’ বলায় দিল্লির কর্তাদের গোঁসা হলেও, এটা ঘটনা যে নিজেরা আর্থিক বিকাশ ও পরিষেবার ক্ষেত্রে দিশাহীন বলেই (আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন তুলে) গোটা দেশকেই দিশাহীন করে রেখেছেন। যখন সবাই বুঝছে, সর্বনাশ শিয়রে, তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে উল্টোপাল্টা বকে চলেছেন।
আরও পড়ুন: পরিস্থিতি বিপজ্জনক, খুব জরুরি রফতানি নিয়ে ভাবনাও
স্বপ্ন দেখা অবশ্য ভাল। উনিশ শতকে বাংলার মনীষী ভূদেব মুখোপাধ্যায়, স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস নামে (পাণিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পর) সমৃদ্ধ ও সম্প্রীতিময় ভারতের এক ‘কাল্পনিক ইতিহাস’ রচেছিলেন। মোদী-শাহ-সীতারমনরা বোধহয় এখন স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ‘ভবিষ্যৎ’ নামে একটি পুস্তিকা লেখার ফেরে আছেন, যে-ভারত বিদ্বেষে বিভাজিত, অথচ তার জিডিপি-র হার লাফিয়ে বেড়ে চলেছে ৭ থেকে ৯, ৯ থেকে ১১, ১১ থেকে...!
আরও পড়ুন: ঋণ পেলেই তো হবে না, কাজে লাগাতে হবে, কারণ গুনতে হবে সুদ
(লেখক বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক)
গ্রাফিক: সৌভিক দেবনাথ