সমগ্র বিশ্বে যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের শীর্ষ ছুঁয়েছেন, প্রায় সবার ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও নারীর ত্যাগব্রতে নন্দিত ও ললিত হাতের স্পর্শ আর আকাশ-উদার স্বার্থশূন্য হৃদয়ের প্রণোদনা রয়েছে। সে ভূমিকায় জননী, জায়া, প্রেমিকা, কাছের মানুষ, কন্যা— যে কেউ অবতীর্ণ হয়ে দুরন্ত ঢেউয়ের মাথায় দোল খাওয়া ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নগুলোর সুমধুর সহাবস্থান ঘটিয়ে দিতে পারেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জায়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগই সৃষ্টিশীলতার পথকে কুসুম বিছিয়ে মসৃণ করে দেয়।
‘চারিত্রপূজা’র ‘বিদ্যাসাগর চরিত’এ রবীন্দ্রনাথ লিখলেন— ‘‘মহাপুরুষের ইতিহাস বাহিরের কার্যে এবং জীবনবৃত্তান্তে স্থায়ী হয়, আর মহৎ নারীর ইতিহাস তাঁহার পুত্রের চরিত্রে, তাঁহার স্বামীর কার্যে রচিত হইতে থাকে, এবং সে লেখায় তাঁহার নামোল্লেখ খাকে না।’’ কিন্তু বিদ্যাসাগরের জীবনে মা ভগবতী দেবীর অপরিসীম প্রভাব বিশ্বাস-অবিশ্বাসে মিলিয়ে উপর্যুপরি আবেগ ঘনিষ্ঠতায়, কখনও কখনও অতিরেক দুষ্টতায়ও দুষ্ট হয়েছে। কিন্তু মাতা-পুত্রের সম্পর্কের গভীরতায় সে দুষ্টতা ম্লান হয়ে বরং প্রতিনিয়ত আমাদের শ্রদ্ধা আদায় করে নেয়। অথচ, বিদ্যাসাগর-বণিতা দীনময়ী চিরকালই থেকে গিয়েছেন আলোকবৃত্ত থেকে অনেক দূরের অন্ধকার আবর্তে। তাঁর ত্যাগ, তিতিক্ষা, ঔদার্য ছাড়া ঈশ্বরচন্দ্রের ‘বিদ্যাসাগর’ হয়ে ওঠা কতটা সম্ভব ছিল, সেই বিরাট প্রশ্নচিহ্নের গা ঘেঁষে কোনও বিদ্যাসাগর জীবনীকারের কলম দু-এক ফোঁটা কৃপাকালিও বর্ষণ করেনি তাঁর জন্য।
১৮৩৪-এর ফাল্গুনের জ্যোৎস্না প্লাবিত যে রাতে মেঘেরা চন্দ্রাভিসারে চলেছিল, আর ঈশ্বরচন্দ্র চলেছিলেন দীনময়ী নাম্নী অষ্টমবর্ষীয়া এক বালিকার পুতুলখেলা অপুষ্ট হাতে পানিগ্রহণের প্রতিশ্রুতি তুলে দিতে— সে রাতের কথা জীবনে আর কী কখনও তাঁর স্মৃতির পাতায় ভিড় করেছিল? না করারই কথা। কারণ তিনি তখন চোদ্দো বছরের কিশোর। সাহিত্য শ্রেণির ছাত্র। এই বয়সেই গ্রামের নানা অনুষ্ঠানে কবিতা রচনা করে পাঠ করেন। পণ্ডিতদের সঙ্গে অনর্গল সংস্কৃত ভাষায় ব্যাকরণের বিচার করেন। এখনই বিয়ের পিঁড়িতে বসার বিন্দুমাত্র বাসনা ছিল না তাঁর। কিন্তু পিতার কঠোর আদেশ অগ্রাহ্য করার মতো সাহস ছিল না বলেই তিনি সম্মত হয়েছিলেন। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতেই সোজা কলকাতায়। সামনেই সাহিত্য শ্রেণির পরীক্ষা। তাই বীরসিংহে আর থাকা চলে না। যাওয়ার সময় শুধু ঠাকুমাকে বলে গেলেন— ‘এখন নাতির বিয়ে দিলে, নাতবৌ নিয়ে নৃত্যগীত আমোদ-আহ্লাদ করো।’
ক্ষীরপাই গ্রামে দীনময়ীর জন্ম ১৮২৬-এ। তিনি শুধু সুন্দরীই নন, সুলক্ষণাও। ক্ষীরপাই তখন সর্বোত্তম গ্রামের শিরোপা লাভ করেছে। ক্ষমতায়, মানে, অর্থে তাঁর বাবা গ্রামে বেশ খ্যাতিমান। ছিলেন বলশালীও। এক মত্ত হস্তীকে তিনি নাকি একাই জব্দ করেছিলেন। জেদি এবং দৃঢ়চেতা হলেও তাঁর মানসিকতা ছিল উদার। দরিদ্র ঠাকুরদাসকে তিনি বলেছিলেন— ‘ঈশ্বর বিদ্বান হইয়াছেন; সৎপাত্রে কন্যাদান করিতে আমি বাসনা করিয়াছি।’ ধনীর আদুরে কন্যার বিয়ে হল। কিন্তু তিনি বিয়ের কিছুই বোঝেন না। তবু লোকচক্ষুর অন্তরালে বালক বরকে সংগোপনে খুঁজে ফেরেন। কিন্তু তিনি তো কলকাতায় নিবিড় পাঠে নিমগ্ন। এদিকে বীরসিংহে শুরু হল দীনময়ীর ‘একলা-যাপন’ পর্ব।
দীনময়ী ধীরে ধীরে পা রাখছেন ‘কিশোরী’র অঙ্গনে। আর পুঞ্জীভূত বিরহের বর্ণবিন্যাসে দীনময়ীর অন্তরের বেলাভূমিতে প্রতিদিন যে চিত্রকল্পের জন্ম হচ্ছে, সমুদ্রে ঝুঁকে পড়া দিগন্ত ছাড়া আর কাকেই বা তিনি জানাতে পারেন সে কথা। কারণ, ঈশ্বরচন্দ্র তখন কলকাতায় সাফল্যের সোপানে পা রেখে রেখে কৃতিত্বের সর্বোচ্চ শিখর ছোঁয়ার উদগ্র বাসনায় আকাশমুখী। ১৮৩৪-৩৫ সালে সাহিত্য শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন। অলঙ্কার, বেদান্ত এবং স্মৃতিতেও আকাশছোঁয়া সাফল্য। কৃতিত্বের ছাপ রাখলেন ১৮৩৯-এর ২২ এপ্রিলে হিন্দু-ল-কমিটির পরীক্ষায় বসেও। মে মাসে হিন্দু-ল-কমিটি অব এক্সামিনেশনের সার্টিফিকেটে ভূষিত হলেন ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিতে। ১৮৪১-এর ৪ ডিসেম্বর সংস্কৃত কলেজের শংসাপত্র যখন পান, তখন তাঁর বয়স ২১ বছর। প্রায়-অচেনা স্বামীর এই সাফল্য, ঈশ্বরচন্দ্রের স্ত্রী থেকে বিদ্যাসাগরের স্ত্রী-তে উত্তরণ দীনময়ীকে আহ্লাদিত করার পরিবর্তে তাঁর একলা যাপনের যন্ত্রণাকেই বরং বাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৮৪১-এর ২৯ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগরের কর্মজীবন শুরু হল ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলা বিভাগের সেরেস্তাদার (প্রধান পণ্ডিত) হিসেবে। তার পর তো ব্যস্ততার সাতকাহন। সমাজসংস্কার, শিক্ষাপদ্ধতির উন্নয়ন, স্ত্রী শিক্ষার বিস্তার, গ্রন্থ রচনা— এই বিপুল কর্মযজ্ঞের তিনি পুরোহিত।
বীরসিংহে যদিও আসেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন হাজারো ব্যস্ততা। অনেক দিন পর স্বামীর পর্দাপণ ঘটেছে দীনময়ীর ঘরে। রাতে খাওয়ার পর দীনময়ীর হাত থেকে পানের খিলি নিয়ে মুখে দিতে দিতে একটা-দুটো কথার পর, আলো জ্বেলে লিখতে বসলেন বিদ্যাসাগর। স্বগতোক্তির মতো দীনময়ীকে বললেন— ‘রাস্তায় আসতে আসতে মনে হ’ল সীতার বনবাস নিয়ে একখানা বই লিখলে বেশ হয়। পাঁচ কাজে হয়তো ভুলে যাব, খানিকটা ফেঁদে রাখি।’ দীনময়ী জিজ্ঞাসা করলেন— ‘কী বই লিখছ বললে? সীতার বনবাস? সীতার দুঃখ বোঝো তুমি?’ কিছু ক্ষণ পর প্রতিবেশী নিবারণের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বেরিয়ে গেলেন বিদ্যাসাগর। বনফুল তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থে লিখছেন—‘‘জ্যেৎস্নালোকিত বাতায়নের সম্মুখে দীনময়ী প্রস্তরমূর্তিবৎ দাঁড়াইয়া রহিলেন।’’ সে রাতেও উপেক্ষিত অন্ধকারের ভ্রুকুটি গায়ে মেখে শয়নকক্ষে একাকী দীনময়ী।
১৮৪৯-এর ১৪ নভেম্বর বিদ্যাসাগরের প্রথম সন্তান নারায়ণের জন্ম হল। তখন দীনময়ীর বয়স ২৩ বছর। বিবাহের পর দীর্ঘ ১৫ বছর সন্তানহীনা থাকায় তাঁকে কম গঞ্জনা সহ্য করতে হয়নি। ‘বাঁজা নারী’র তকমা দিয়ে তুকতাক, জড়িবুটি, জলপড়া-তেলপড়া প্রভৃতির যন্ত্রণা নীরবে বিদীর্ণ করে গিয়েছে তাঁকে। কিন্তু তাঁর রাতযাপনে তো স্বামীর স্পর্শ নেই। বরং থুরথুরে প্যাঁচার ডানায় ভর দিয়ে প্রকৃতির বুকে নামা অন্ধকার দীনময়ীর অভিমানের বাতায়ন বেয়ে শয়নকক্ষ ছুঁয়ে ক্রমশ হেঁটে গিয়েছে দিনলিপির কক্ষান্তরে। তা হলে তিনি মা হবেন কী করে? মাতৃত্বের অধিকার থেকে স্বামীই তো তাঁকে বঞ্চিত করে চলেছেন এই দীর্ঘ ১৫ বছর। অথচ, এই দীর্ঘকাল বিদ্যাসাগর কলকাতায় সংস্কারমুক্ত সমাজ গড়ে নারীকে মুক্ত আকাশ উপহার দেওয়ার লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। নারায়ণের জন্মের পর আরও চার কন্যার জননী হয়েছেন দীনময়ী— হেমলতা, কুমুদিনী, বিনোদিনী এবং শরৎকুমারী। কিন্তু দাম্পত্য সম্পর্কের বুনন অটুট হয়নি। কারণ, দীনময়ী সন্তানসন্ততি নিয়ে বীরসিংহে আর বিদ্যাসাগর যথারীতি কলকাতায়।
১৮৪৯-এ ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুন কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন (বর্তমানে বেথুন স্কুল), যার অবৈতনিক সম্পাদকের দায়িত্ব নিলেন বিদ্যাসাগর। নারীশিক্ষার উন্নয়নে দেশবাসী ও সমাজকে সচেতন করতে বেথুন স্কুলের ছাত্রীদের গাড়ির দুই পাশে লিখে দিলেন ‘মহানির্বাণতন্ত্র’-এর সেই বিখ্যাত শ্লোক— ‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষনীয়াতিযত্নতঃ।’ অর্থাৎ কন্যাকেও অতি যত্ন সহকারে পালন করা ও শিক্ষা দেওয়া কর্তব্য। যার হাতে স্ত্রী শিক্ষার প্রদীপ, বীরসিংহে তার ঘরেই আঁচলে অশিক্ষার অন্ধকার বেঁধে স্ত্রী দীনময়ী যাপন করে চলেছেন শিক্ষাহীন বন্ধ্যা সকাল-দুপুর-রাত। বিদ্যাসাগরের জীবনীকার এস কে বসু তাঁর ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থে বলেছেন—‘‘ভাবলে অবাক হতে হয় যে, বিদ্যাসাগরের মতো বিখ্যাত স্বামীর ঘটনাবহুল জীবনে তাঁর স্ত্রী দয়াময়ী দেবীর কোনো ভূমিকাই ছিল না। নিজে স্ত্রী শিক্ষার অতি আগ্রহশীল সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর স্ত্রীকে লেখাপড়া শেখাননি।’’
(উদ্ধৃতির বানান অপরিবর্তিত)
সরিষাডাঙ্গা ড. শ্যামাপ্রসাদ হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক