গত বছরের মে মাস। বর্ধমান থেকে কলকাতা যেতে হয়েছিল। জাতীয় সড়কে উঠতেই খেয়াল হল সঙ্গে জলের বোতল নিইনি। গাড়ির চালককে বললাম, গাড়িটা সামনের কোনও দোকানে দাঁড় করাতে। কিন্তু কয়েকটি হোটেল ঘোরার পরেও জল মিলল না। জানা গেল, সব দোকানেই জলের বোতল বিক্রি হয়ে গিয়েছে। তেষ্টায় তখন ছাতি ফেটে যাওয়ার জোগাড়। শেষে এক প্রকার বাধ্য হয়ে হোটেলের মালিককে বললাম, ‘‘দাদা মিনারেল ওয়াটার যদি না থাকে, অন্তত এক গ্লাস টিউবওয়েলের জল দিন।’’ তিনি স্মিতহাস্যে বললেন, ‘‘দাদা এই গরমে নলকূপ থেকে জল উঠছে না। রান্নার জন্য আধ মাইল দূর থেকে জল আনতে হচ্ছে।’’ অনেক বলার পরে দোকানের একটি ছেলে এক গ্লাস জল আনল। তাতে আবার দুর্গন্ধ। গত কয়েক বছরে গরমের সময় বাইরে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই হয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর তীব্র জলাভাব তৈরি হয়েছিল চেন্নাইয়ের মতো শহরে। নীতি আয়োগের সমীক্ষা বলেছিল, ২০২০ সালের আশেপাশেই দিল্লি-সহ ভারতের বেশ কয়েকটি শহরের ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডার শূন্য হয়ে যাবে। এখনও গরম কাল আসেনি। এই আশঙ্কাকে বুকে নিয়েই পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব জল দিবস’। ভারত তো বটেই, বিশ্বের সব প্রান্তেই জলের আকাল যে ভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছে, তাতে জল দিবস সত্যিই আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। গত বছর আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার জন্য জল-সহ প্রকৃতির স্বাভাবিক চক্রগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করছেন পরিবেশবিদেরা। তাঁদের দাবি, সময়ে বর্ষা না আসা, কম সময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি, শীতে বৃষ্টিপাত, দাবানল-সহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে গোটা বিশ্ব এক অদ্ভুত সঙ্কটের মুখে। এই অবস্থায় জলের জন্য আকাল পড়ার আশঙ্কা রয়েছে সর্বত্র।
গত এক দশকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ায় ক্রমেই বেড়েছে সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা। মেরু প্রদেশে জমা বরফ গলার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে শুরু করেছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ২০০২ সালে দক্ষিণ মেরুর ‘লার্সেন বি আইস সেল্ফ’ টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। ২০১৭ সালে ‘লার্সেন সি আইস সেল্ফ’-এর একটি বড় অংশ ভেঙে এক বিরাট হিমবাহ তৈরি হয়েছে। ২০০৩ সালে উত্তর গোলার্ধে মেরু সাগরের বরফ পাহাড় ‘ওয়ার্ড হান্ট আইস সেল্ফ’ ভেঙে বিশাল তিনটি হিমবাহ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে গলতে শুরু করেছে পাহাড়ের গায়ে থাকা হিমবাহও। কিছু দিন আগে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এভারেস্টের বরফ গলে মৃত পর্বতারোহীরর মৃতদেহ বেরিয়ে পড়ার ছবি রীতিমতো চাঞ্চল্য ফেলেছিল।
পরিসংখ্যান বলছে, এই হারে চলতে থাকলে সমুদ্রপৃষ্ঠের জলের উচ্চতা বাড়বে। কয়েক মিটার জলস্তর বাড়লেই বিপদে পড়বে সুন্দরবনের মতো সমুদ্রের উপকূলে থাকা অরণ্য। আর তার পরে বিপদে পড়বে টোকিয়ো, সাংহাই, কলকাতা, লন্ডনের মতো শহর। ‘ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেটের’-এর রিপোর্ট বলছে, ইতিমধ্যেই পৃথিবীর সমুদ্রের জলের উচ্চতা প্রায় এক ইঞ্চি বেড়েছে। এই হারে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হলে ২১০০ সালের মধ্যে জলতলের উচ্চতা তিন ফুট পর্যন্ত বাড়বে। তাতে লুপ্ত হবে বিশ্বের বহু জনবহুল শহরের অস্তিত্ব। এবং তার থেকেও বড় কথা, সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা বাড়লে নদী থেকে সমুদ্রের দিকে জলের যে প্রবাহ তাও বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরিবেশবিদদের একাংশের মতে, নদীর থেকে সমুদ্রের জলতল বেড়ে গেলে উল্টোমুখী প্রবাহ দেখা দেবে। তাতে মোহনা হয়ে সমুদ্রের লবণাক্ত জল লোকালয়ে ঢুকে ক্ষতি করবে চাষাবাদ, মাছ প্রতিপালনের মতো কাজের। পরিসংখ্যান অনুসারে, রাজ্যের উপকূলভাগের চারটি জেলার ৫৯টি ব্লকের জলে লবণ মিশে গিয়েছে। ফলে ভূপৃষ্ঠের জলও ক্রমশ পানের আযোগ্য হয়ে পড়ছে।
গত কয়েক দশকে অরণ্য ধ্বংস, ভূপৃষ্ঠকে ক্রমশ পিচ ও কংক্রিটের চাদরে মুড়ে ফেলার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জলের স্বাভাবিক চক্র। ফলে বৃষ্টির জল ভূস্তরে পড়লেও তা মাটির নীচে পৌঁছতে পারছে না। ফলে তা ফের বাস্পীভূত হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশছে। এতে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প ও মেঘ বাড়ায় অসময়ে বৃষ্টি, নিম্নচাপের মতো প্রাকতিক দুর্যোগ বাড়ছে। অন্য দিকে, কমছে ভূগর্ভস্থ জলস্তর। এই জলতলের উচ্চতা কমার সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসতে শুরু করেছে আর্সেনিকের মতো বিষাক্ত পদার্থ। ফলে বাড়ছে জলবাহিত নানা রোগের প্রকোপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বয়ান অনুসারে, পানীয় জলে আর্সেনিকের সহনশীল মাত্রা হল ০.০১ মিলিগ্রাম। আবার ভারতীয় মানদণ্ড অনুসারে, এর ঊর্ধ্বসীমা প্রতি লিটারে ০.০৫ মিলিগ্রাম। তবে বর্তমানে ভূগর্ভের একেবারে নিম্নস্তর থেকে যে জল উঠছে তাতে আর্সেনিকের মাত্রা যথেষ্ট বেশি। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক হওয়া একটি সমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্য জানাচ্ছে, এই রাজ্যের ৩৪১টি ব্লকের মধ্যে ১০৮টির জলে আর্সেনিকের খোঁজ মিলেছে। এবং সাতটি জেলার ৪৩টি ব্লকে ভূগর্ভস্থ জল ফ্লোরাইড দূষণে দুষ্ট। এই তালিকায় রয়েছে কলকাতাও।
ভূ-গর্ভস্থ জল তোলায় দেখা দিচ্ছে অন্য এক বিপদও। জল তোলায় ক্রমশ ভূ-গর্ভ ফাঁকা হয়ে বাড়ছে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের আশঙ্কা। ভারতের প্রায় প্রতিটি জেলাতে ভৌম জলস্তর বছরে চার থেকে দশ মিটার নামায় শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে ভূ-অভ্যন্তরে। ফলে বাড়ছে সুনামি, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপদের ঝুঁকিও। ২০১১ সালের মার্চে ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সুনামি সুরক্ষিত সমুদ্র-প্রাচীর ছাপিয়ে জাপানের মিয়াকো শহরের দশ কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে পরেছিল। এতে ৪৫,৭০০টি বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয় এবং প্রায় আড়াই লক্ষের কাছাকাছি গাড়ি ভেসে যায়। প্রায় ১৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে ভূগর্ভ জলশূন্য হলে ভূ-অভ্যন্তরীণ চাপে ভারসাম্যেও বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা করছেন গবেষকেরা।
এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে শুরু হয়েছে জল নিয়ে রাজনীতি। আগামী দিনে জল যদি একটি দুর্মূল্য সামগ্রীতে পরিণত হয় তবে তাকে ঘিরে ব্যবসার আশঙ্কাও রয়েছে। এই কারণে বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশগুলি এখন থেকেই মিষ্টি পানীয় জলের উৎসগুলির দখল নিতে তৎপর। তারই সঙ্গে জলসম্পদে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে শুরু হয়েছে বাঁধ রাজনীতিও। আবার জলের অভাবকে কাজে লাগিয়ে শক্তিসম্পদের দখল নেওয়ারও চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গিয়েছে, জলের অভাবে শুকিয়ে গিয়েছে ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত। ফলে আফ্রিকার বিস্তীর্ণ প্রান্তে টান পড়েছে জলবিদ্যুতে। সেই বাজার ধরতেও সচেষ্ট হবে উন্নত দেশগুলি। নিজেদের ভৌগলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে বহু দেশ চেষ্টা করছে বাঁধের সাহায্যে নদীর বেশি পরিমাণ জল সংরক্ষিত করার। ফলে দেখা দিচ্ছে সংঘাত। জলের অভাব তীব্র হলে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের, ভারতের সঙ্গে চিনের বাঁধ রাজনীতিকে নিয়ে সংঘাত যুদ্ধে গড়ানোর আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
পৃথিবীর তিন ভাগ জল এবং এক ভাগ স্থল। কিন্তু এই তিন ভাগের মধ্যে বেশিরভাগ জলই যে পানের অযোগ্য তাও আমরা জানি। তা সত্ত্বেও পানীয় জলে বাঁচানোর চেষ্টা না করায় এক অনিবার্য সঙ্কট এসে উপস্থিত হয়েছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য ব্যবহৃত জলের পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ, ভৌমস্তরে জল প্রবেশের ব্যবস্থা করা-সহ বহু পরিকল্পনা করা দরকার। তা না হলে কিন্তু মানব সভ্যতার ভিত্তিও বিপন্ন হতে পারে।
লেখক ও গবেষক