ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ডোনাল্ড ট্রাম্প থাকিবেন আর প্রাচীর থাকিবে না, তাহাও কি হয়? মার্কিন প্রেসিডেন্টের আমদাবাদ সফর উপলক্ষে প্রাচীর তুলিতেছেন নরেন্দ্র মোদী। তাহাতে চাপা পড়িবে বিমানবন্দর হইতে ইন্দিরা সেতু অবধি আধ কিলোমিটার সড়কের দুই পার্শ্বের বস্তি ও ঝুপড়ি। কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানাইয়াছে, ট্রাম্পের নিরাপত্তার স্বার্থেই এই ব্যবস্থা— কিন্তু, বুঝ লোক যে জানো সন্ধান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যাহাতে ‘দৃশ্যদূষণ’-এ বিব্রত না হন, সেই কারণেই এই বন্দোবস্ত বলিয়াই সন্দেহ। ইহার পূর্বে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং এবং জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে-র আমদাবাদ আগমন উপলক্ষে ঢাকা পড়িয়াছিল নগরীর দরিদ্র অঞ্চল। সেই বার সবুজ কাপড় ‘আব্রু’ রক্ষার দায়িত্ব লইয়াছিল। এ-ক্ষণে সম্ভবত বন্দোবস্তটিকে চিরস্থায়ী করা হইল। প্রশ্ন উঠিতে পারে— তৃতীয় বিশ্বের দেশে দারিদ্র থাকিবেই, অপর রাষ্ট্রনেতারাও উহা অবগত, তবে কেন তাহাকে লুকাইবার এই (অপ)চেষ্টা? সন্দেহ হয়, ইহা হীনম্মন্যতার প্রকাশ। আরও সন্দেহ হয়, সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ না থাকিবার প্রবৃত্তি বড় প্রকট।
এই প্রবণতার ফলেই কেবল বস্তি বা ঝুপড়ি নহে, অর্থনৈতিক তথ্যও একই ভাবে সযত্নে লুকাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিয়া থাকে মোদী সরকার। ২০১৭-১৮ এনএসএসও-র সমীক্ষায় ধরা পড়িয়াছিল ৬.১ শতাংশ বেকারত্বের তথ্য, যাহা চার দশকে সর্বাধিক। সরকার সেই তথ্য চাপিবার চেষ্টা করিয়াছে— এই অভিযোগে পদত্যাগ করিয়াছিলেন ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল কমিশনের দুই স্বাধীন সদস্য। ইহার পূর্বে জিডিপি এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির তথ্যও বিকৃত করিবার অভিযোগ উঠিয়াছিল এই সরকারের বিরুদ্ধে। শ্রম দফতরের চতুর্মাসিক সমীক্ষার রিপোর্টও ২০১৮ সালের মার্চের পর আর প্রকাশিত হয় নাই। বস্তুত, দায়িত্ব যথাযথ পালিত হউক বা না হউক, অস্বস্তিদায়ক বিষয়গুলিকে লুকাইয়া ফেলিতে সরকারের তৎপরতা প্রশংসার দাবি রাখে। বাস্তব হইল, ভারতে মাথাপিছু আয় হ্রাস পাইতেছে, ধনবৈষম্য বৃদ্ধি পাইতেছে, কিন্তু তাহা মেরামত করিবার পরিবর্তে তথ্যাবলি জনসমক্ষে প্রকাশ পাইতে না দেওয়া লইয়া সরকারের চিন্তা অধিক।
যাঁহার আমলে দেশে বৈষম্য বাড়িয়াছে, দায় তাঁহাকে লইতেই হইবে। গত বৎসর এক বিদেশি পত্রিকার দেওয়া ‘বিভাজক সর্দার’ তকমা তাহা সুপ্রতিষ্ঠিত করে। যে ভাবে ধর্ম, জাতপাত, পোশাক, খাদ্যাভ্যাসের ভিত্তিতে এক গোষ্ঠীর মানুষকে উন্নয়নের আলো হইতে দূরে ঠেলিয়া দেওয়া হইতেছে, দেশের অর্থনীতি তাহার ফলেও ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে। তাঁহার গুজরাত মডেল বিভাজনেরই প্রদর্শন। সেইখানে বহু মানুষ অনুন্নয়ন ও বঞ্চনার শিকার, ইহা অপেক্ষা বড় কথা তাহা চাপিয়া রাখার চেষ্টা। বিজেপির দীর্ঘ নিরবচ্ছিন্ন শাসনকালে মসৃণ রাস্তাঘাট, দামি আবাসন, চকচকে শপিং মল তৈয়ারি হইয়াছে বটে, কিন্তু সকল নাগরিক এক বন্ধনীতে আসেন নাই। সোভিয়েত আমলে এক ভারতীয় বামপন্থী সাংবাদিক কমিউনিস্ট দেশের ‘লৌহ যবনিকা’র বিরুদ্ধে নেহরু সরকারের ‘খাদি যবনিকা’র কথা বলিতেন। ইটের প্রাচীর বা সবুজ কাপড় আজ সেই তকমা লাভ করিতেই পারে। সকলের সহিত সকলের বিকাশ, এবং সকলের বিশ্বাসের যে চিৎকৃত স্লোগানে কান পাতা দায়, উক্ত দেওয়ালই তাহার প্রকৃষ্টতম লিখন।