সত্যিই কি ধাক্কা খেল শাসক

বিজেপির সমর্থনের ভিত মোটেই নাটকীয় ভাবে কমেনি

আপাত ভাবে এই ভোটে বিজেপি ধাক্কা খেয়েছে মনে হলেও বাস্তবটা বরং তার উল্টো। তাদের সমর্থনের ভিত কিন্তু মোটেই নাটকীয় ভাবে কমেনি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৯ ০০:৪৫
Share:

জয়ী: হরিয়ানার ঘরোন্দা কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থী হরবিন্দর সিংহ কল্যাণের সমর্থকরা। ২৪ অক্টোবর। পিটিআই

সদ্যসমাপ্ত মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে দৃশ্যত খারাপ ফল করেছে বিজেপি। ভোটের আগে দুই রাজ্যেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরবে বলে দাবি করেছিল কেন্দ্রের শাসক দল। দু’টি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যেই তা হল না, এবং সরকার গঠন করতেও বেশ বিপাকে পড়েছে তারা। হরিয়ানায় নবগঠিত জাঠ দল জননায়ক জনতা পার্টির (জেজেপি) সঙ্গে জোট বাঁধতে হয়েছে। মহারাষ্ট্রে শরিক শিবসেনা আচমকা নতুন কিছু দাবি জানিয়ে বসায় এখনও সরকার গঠন করা যায়নি। সেনা জানিয়েছে, আড়াই বছর করে দু’দলের মধ্যে ভাগ করে নিতে হবে মুখ্যমন্ত্রীর পদ। অতএব একেবারেই স্বস্তিতে নেই বিজেপি, কেননা দুই রাজ্যেই এত দিন নিরাপদ ভাবে ক্ষমতায় ছিল তারা।

Advertisement

তবে এটাই পুরো কাহিনি নয়। বিজেপি আর তার শরিকরা হয়তো ভোটের সময় কিংবা তার ফল বেরোনোর পর ধাক্কা খেয়েছে, কিন্তু সেটা কি রাজনৈতিক ভাবে বিরাট বদলের ইঙ্গিতবাহী? না কি, এই ফল বস্তুত চক্রবৎ ঘুরতে থাকা প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা? সুতরাং প্রশ্নটা হল, দুই রাজ্যে কী কারণে বিজেপির ভাগ্যের চাকা উল্টে গেল? দুই রাজ্যে কি হঠাৎ করেই তাদের সমর্থন একেবারে ধসে গেল?

আপাত ভাবে এই ভোটে বিজেপি ধাক্কা খেয়েছে মনে হলেও বাস্তবটা বরং তার উল্টো। তাদের সমর্থনের ভিত কিন্তু মোটেই নাটকীয় ভাবে কমেনি। হরিয়ানায় তো বিজেপির ভোট শতাংশ ২০১৪ সালের ৩৩.২ শতাংশ থেকে বেড়ে এ বার ৩৬.৪৯ শতাংশ হয়ে গিয়েছে। মহারাষ্ট্রে সামান্য কমেছে— ২৭.৮১ শতাংশ থেকে ২৫.৭৫ শতাংশ। যদিও, দুই রাজ্যেই তাদের আসন সংখ্যা কমেছে। ২০১৪ সালে হরিয়ানায় তারা ৪৭টি আসন পেয়েছিল, যা ৯০ আসনের বিধানসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এ বছর বেশি ভোট পেয়েও আসন নেমে এসেছে ৪০-এ। একই ছবি মহারাষ্ট্রেও। ২০১৪ সালের ভোটে সেখানে ১২২টি আসন পেয়েছিল বিজেপি, শরিক শিবসেনা পেয়েছিল ৬৩। দুইয়ে মিলে ২৮৮ সদস্যের বিধানসভায় স্বস্তিদায়ক গরিষ্ঠতা ছিল তাদের। এ বার বিজেপি নেমে গিয়েছে ১০৫-এ, এবং শিবসেনা জিতেছে ৫৬টি আসন। তা অবশ্য সরকার গঠন করার জন্য যথেষ্ট। এবং বেশির ভাগ নির্দল প্রার্থীই— যার অধিকাংশই আবার বিক্ষুব্ধ বিজেপি— সেখানে বিজেপিকে সমর্থন করতে রাজি হয়েছে। সব মিলিয়ে, বিজেপির জনভিত্তিতে বিরাট ধস নেমেছে, এতটা বলা চলে না। তাদের ভোটব্যাঙ্ক সুরক্ষিতই আছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির জনপ্রিয়তাও একই রকম আছে।

Advertisement

তবে একটা বড় অংশের মানুষ বিজেপি ও তার ডাকাবুকো নেতৃত্বকে ভোট দেন না। জনসাধারণের এই অংশটার মধ্যে কী পরিবর্তন ঘটে চলেছে, সেটা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

হরিয়ানার তৃণমূল স্তর থেকে পাওয়া খবর অনুসারে, বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টরের বিরুদ্ধে শাসক দলের মধ্যেই ক্ষোভ চরমে পৌঁছেছে। মহারাষ্ট্রে এই প্রবণতা তুলনায় কম, কেননা ফডণবীশ সরকার কাজ তত খারাপ করেনি। তবে দুই রাজ্যেই বেড়ে চলা অসন্তোষ এখনও সংহত নয়। এর প্রধান কারণ— বিরোধী দলের প্রতি আস্থার অভাব। এবং তার সঙ্গে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা দলগুলির বাড়বাড়ন্ত। লক্ষণীয়, আপ, ফরওয়ার্ড ব্লক, সিপিআই, সিপিএম, জেডিইউ, অকালি দল, ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ, এসপি-র মতো জাতীয় দলগুলি একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। দুই রাজ্যেই এক শতাংশেরও কম ভোট পেয়েছে তারা। রাজ্য স্তরে জাতপাতের রাজনীতি করা দলগুলি তাদের ভোটে ভাগ বসিয়েছে। এ বারের ভোটে এ রকম দু’টি দল বিশেষ ভাবে উঠে এসেছে। হরিয়ানায় জেজেপি পেয়েছে ১৪.৮ শতাংশ ভোট এবং ১০টি আসন। বহুজন বিকাশ আঘাডী— মূলত বৃহত্তর মুম্বইয়ের বসই এলাকার একটি দল— ওই এলাকায় বেশির ভাগ জাতীয় দলের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে, এবং আসন জিতেছে ৩টি।

সম্ভবত সবচেয়ে হতাশাজনক ফল করেছে কংগ্রেস। ভোটারদের ক্রমবর্ধমান অস্থিরতাকে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। কার্যকর বিরোধী শক্তি হিসেবেও ভূমিকা নিতে পারেনি। এর কারণও স্পষ্ট। নতুন নেতা কিংবা রাজ্য নেতৃত্বকে দায়িত্ব না ছেড়ে এখনও পার্টির হাল ধরে আছে সেই বিফল দলপতিরাই। হরিয়ানায় কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিংহ হুডা অভিযোগ করেছেন যে হাইকম্যান্ড আরও বেশি সময় দিলে দল আরও অনেক ভাল ফল করতে পারত। গুরুত্বহীন অশোক তানওয়ারকে হরিয়ানা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে তুলে ধরায় সে রাজ্যে দলের মনোবল একেবারে ভেঙে গিয়েছিল। ভোটের ঠিক এক মাস আগে তানওয়ারকে বার করে দিয়ে কুমারী সেলজাকে রাজ্য সভাপতি করে কংগ্রেস। তাড়াহুড়ো করে হুডাকে পরিষদীয় দলের নেতা ঘোষণা করা হয়। বহিষ্কৃত তানওয়ার আবার প্রকাশ্যে দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে পরিস্থিতি জটিল করে তোলেন। মহারাষ্ট্রে এনসিপি-র প্রতিষ্ঠাতা, এক কালের পোড়-খাওয়া কংগ্রেস নেতা শরদ পওয়ারকেও কিন্তু তারা নিজেদের দলের কাজে লাগাতে পারেনি। কংগ্রেসের তরফে একই রকম সংগঠনের অভাব দেখা গিয়েছে দেশ জুড়েই।

অক্টোবরের নির্বাচন থেকে যদি কোনও বার্তা পাওয়ার থাকে তা হল— কলহদীর্ণ বিরোধী শিবির কিংবা হীনবল কংগ্রেস, এদের নিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়া যাবে না। পরিবারকে শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করতেই হবে— আক্ষরিক অর্থেও, ভাবনার দিক থেকেও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement